১৯৭১ সালের ২ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন মুক্তিবাহিনীর সাহসী নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন, এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভ্রান্ত নীতির প্রকাশ ঘটে। এদিনের ঘটনাবলি মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে আরও গতিশীল করে তোলে।
২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশে একটি লোকও জীবিত থাকা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। পাকিস্তানি সেনাদের সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করেই আমরা থামব।” নিজ পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেন, “অনেক পরিবারের করুণ পরিণতি আমি নিজ চোখে দেখেছি। এখন আমার নিজের কথা ভাবার অধিকার নেই—বাংলাদেশই আমার পরিবার।”
ইরানের শীর্ষ সংবাদপত্র দৈনিক কায়রান-এর রাজনৈতিক সম্পাদক আমির তাহেরি বাংলাদেশ সফরকালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান-এর সাক্ষাৎকার নেন। ২ জুলাই প্রকাশিত তাঁর সম্পাদকীয়তে টিক্কা খানের বক্তব্য উঠে আসে:
“মুজিবুর রহমান ছয় দফার আপোসহীন অবস্থান নেওয়ায় আলোচনার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি সমান্তরাল সরকার গঠন করেন, পাকিস্তানি ব্যাংক নোট বাতিল করেন, এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।”
টিক্কা খান দাবি করেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছিলাম, কিন্তু মুজিবের কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের অখণ্ডতা ভঙ্গের চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে।”
ভারতের লোকসভা-তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং স্পষ্ট করেন, "এ মুহূর্তে স্বীকৃতি দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। যথাযথ সময়েই আমরা তা করব।" তিনি ইয়াহিয়া খানের নীতিকে "বাংলাদেশকে আলাদা করার পথ প্রশস্ত করা" বলে উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের সমালোচনা করেন। সিপিআই নেতা হীরেন মুখোপাধ্যায় কিসিঞ্জারের সফরকে “অনভিপ্রেত” বলতে আহ্বান জানান যদি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ না হয়।
জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করেন, পিপিপি পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে এককভাবে সরকার গঠন করতে পারে।
ওয়ালি খান তাঁর সোভিয়েত সফরকে "ব্যক্তিগত" বলে ঘোষণা দেন, যা পাকিস্তানে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল।
পাকিস্তান সরকার কমনওয়েলথ-এর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে, অভিযোগ করে "সংগঠনটি বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে।"
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী জেনো ফক: “বাংলাদেশের সংকট এখন বৈশ্বিক ইস্যু। শরণার্থীদের রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।”
মার্কিন সিনেটর চার্লস এথিয়ান ও বেডফোর্ড মোর্সে: পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপন।
সিরিয়া ও গাম্বিয়া: পাকিস্তানের "অখণ্ডতা"র পক্ষে সমর্থন জানায়।
কুমিল্লার লাটুমুড়া: মুক্তিবাহিনীর হামলায় ১২ পাকিস্তানি সেনা নিহত।
চাঁদপুরের মতলব: থানা আক্রমণে ৫ পুলিশ ও ৭ রেঞ্জার নিহত; ১ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ।
সুনামগঞ্জ: পাকিস্তানি টহল দল সম্পূর্ণ উৎখাত।
২ জুলাই ১৯৭১-এর ঘটনাপ্রবাহ মুক্তিযুদ্ধের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে শক্তিশালী করে। মুক্তিবাহিনীর অদম্য মনোবল, ভারতের কূটনৈতিক কৌশল, এবং পাকিস্তানের ভুল নীতি বাংলাদেশের বিজয়কে অনিবার্য করে তোলে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (৭ম-১৩শ খণ্ড)
দৈনিক পাকিস্তান, ৩ জুলাই ১৯৭১
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ৩-৪ জুলাই ১৯৭১
সর্বোদয় সাধনা (খান আবদুল গাফফার খানের সাক্ষাৎকার)
মন্তব্য করুন