ঢাকা সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

মিথ্যা তথ্যের জালে নতুন প্রজন্ম!

ড. মো. মারুফ হাসান
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৬:১৩ পিএম
মিথ্যা তথ্যের জালে নতুন প্রজন্ম!

আধুনিক যুগে তথ্য ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে জ্ঞান অর্জনের পদ্ধতি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই বিভিন্ন তথ্যে প্রবেশ করতে পারছে। কিন্তু এ সুবিধার পাশাপাশি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে—‘জ্ঞানভিত্তিক বিভ্রম’ (Knowledge Hallucination)। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে শিক্ষার্থীরা ভুল বা অর্ধসত্য তথ্যকে সঠিক বলে ধরে নেয় এবং এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জ্ঞানভিত্তিক বিভ্রম হলো এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি মনে করে যে, সে একটি বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে, কিন্তু বাস্তবে তার জ্ঞান অসম্পূর্ণ বা ভুল। এটি সাধারণত অতিরিক্ত তথ্যের প্রবাহ, গভীর চিন্তার অভাব, কনফারমেশন বায়াস এবং শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে ঘটে। ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য থাকলেও সব তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়। অনেক শিক্ষার্থী গুগল বা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাওয়া তথ্যকে প্রামাণ্য জ্ঞান করে। এর বেশিরভাগই ভুল বা পক্ষপাতদুষ্ট। দ্রুত তথ্য পাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে গবেষণা না করেই সিদ্ধান্ত নেয়। মানুষ এমন তথ্য খোঁজে, যা তার পূর্বধারণাকে সমর্থন করে, বিপরীত তথ্য উপেক্ষা করে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় রোট memorization (গবেষণা বা বিশ্লেষণ ছাড়াই মুখস্থ করা) বেশি গুরুত্ব পায়, যা জ্ঞানভিত্তিক বিভ্রমকে উৎসাহিত করে।

স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক বিভ্রমের উদাহরণ হিসেবে ইতিহাস বিকৃতি, ভুয়া বিজ্ঞান, গুজবের প্রভাব এবং রাজনৈতিক বিভ্রান্তিকে উল্লেখ করা যায়। অনেক শিক্ষার্থী ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল ইতিহাস শেখে এবং সেগুলোকেই সত্য বলে ধরে নেয়। অনেকে ‘ফ্ল্যাট আর্থ থিওরি’ বা ‘অ্যান্টি-ভ্যাকসিন’ মতবাদকে সত্য বলে মনে করে, যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এগুলো ভুল। কভিড-১৯ মহামারির সময় অনেক শিক্ষার্থী গুজব বিশ্বাস করেছিল যে, ‘লেবু-গরম পানি করোনা সারায়’। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো অপপ্রচার অনেককে ভুল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দেয়।

জ্ঞানভিত্তিক বিভ্রমের প্রভাব ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে পড়ে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে, যুক্তিবাদী চিন্তার অভাব দেখা দেয় এবং অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আস্থা জন্মায়। জাতীয় পর্যায়ে একটি অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, সমাজে মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা সাম্প্রদায়িকতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ বিজ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তা ছাড়া কোনো জাতি এগোতে পারে না।

এ সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন, পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকা এবং প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। শিক্ষাব্যবস্থায় গবেষণা ও বিশ্লেষণ দক্ষতা বৃদ্ধি, মিডিয়া লিটারেসি এবং যুক্তিবাদী চিন্তার প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। বাবা-মা ও শিক্ষকদের উচিত শিশুদের প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করা এবং তাদের ভুল ধারণাগুলো সংশোধন করা। গুগল বা উইকিপিডিয়ার মতো সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্যের চেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যবহার করতে হবে এবং ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার তরুণ প্রজন্মের ওপর। যদি স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা জ্ঞানভিত্তিক বিভ্রমের শিকার হয়, তবে বাংলাদেশ একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু যদি আমরা এখনই সচেতন হই, যুক্তিভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দিই, তবে বাংলাদেশ একটি জ্ঞানভিত্তিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। জ্ঞানভিত্তিক বিভ্রম একটি নীরব মহামারি, যা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননকে ধ্বংস করছে। এটি রোধ করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবার ও সমাজ—সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আসুন, আমরা সঠিক তথ্য চর্চা করি, যুক্তিবাদী হই এবং একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তুলি। কারণ, জ্ঞানই শক্তি আর বিভ্রমই ধ্বংস।

লেখক: ড. মো. মারুফ হাসান | সহযোগী অধ্যাপক, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি

প্রথম প্রকাশ: কালবেলা, ১০ জুলাই ২০২৫

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নতুন আতঙ্ক জিকা ভাইরাস : করণীয় কী?

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ভূতের আক্রমণ

মিথ্যা তথ্যের জালে নতুন প্রজন্ম!

জানুয়ারি থেকে জুন, প্রতিদিন ১১ খুন

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি: জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

১৩ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

১০

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

১১

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

১২

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

১৩

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

১৪

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

১৫

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

১৬

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

১৭

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১৮

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১৯

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

২০