ঢাকা সোমবার, ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

জনগণ আসলে কী চায়

জাহীদ রেজা নূর
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম
আন্দোলনরত জনগণ
আন্দোলনরত জনগণ

ঘোলাটে হয়ে আছে দেশের রাজনীতি। স্বাধীনতা লাভের পর কখনো এতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশ পড়েনি। অরাজকতার আভাস সর্বত্র। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। এমনকি খোদ সরকারের মধ্যেই কোন উপদেষ্টাদের অপসারণ করতে হবে, তা নিয়ে চলছে হল্লা। কেউ চাইছেন আসিফ নজরুল, সালেহউদ্দিন আহমেদ, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদরা উপদেষ্টার পদ থেকে দূর হোক; কেউ চাইছেন মাহফুজ, আসিফরা উপদেষ্টা না থাকুক। আর সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো, প্রধান উপদেষ্টা আর কারও কাছে নয়, এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলামের কাছেই নিজের পদত্যাগের অভিপ্রায় জানালেন!

এরপর যা যা ঘটেছে, সেগুলোও পাঠক জানেন।

বিগত কয়েক দিনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার কোনো সরল ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। একমাত্র দিশাহীন, লক্ষ্যহীন এবং পরিণামহীন ভাবনা থেকেই এই ঘটনাগুলো বেড়ে উঠতে পারে। স্বাধীনতার অর্থ যেন বদলে গেছে। এখন সবাই এতটা স্বাধীন হয়ে উঠেছে যে অন্যের স্বাধীনতা নিয়ে আর ভাবছে না। অন্যকে হুমকি-ধমকি দেওয়ার মধ্যে স্বাধীনতার একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছে। যেকোনো সময় আয় ঘেরাও খেলি, বয়কট খেলি, পদত্যাগ খেলি যেন গায়ে সওয়া হয়ে যাচ্ছে। অপরিপক্ব মস্তিষ্কের ভাবনা যদি দেশজুড়ে রাজত্ব করতে থাকে, তাহলে পথের দিশা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। অনভিজ্ঞতা ও অসততা একসঙ্গে মিললে যা হয়, কোথাও কোথাও তো তারও দেখা পাচ্ছে সাধারণ জনগণ। স্বৈরাচার শব্দটাকে পরিবর্তন করে ফ্যাসিবাদ শব্দটি ব্যাপকভাবে চালু হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, শুধু এই শব্দটির প্রেমেই রাজনৈতিক দলগুলো পড়েনি, কীভাবে তার বাস্তব প্রয়োগ করা যায়, তারও হদিস খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ এক বিতিকিচ্ছি অবস্থা।

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এমন অনেক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীর দেখা মিলেছে, যাঁদের আগে কেউ চিনতেন না। ভাবুক কিংবা চিন্তক হিসেবে তাদের কোনো অবদান আছে বলেও কেউ শোনেননি। কিন্তু এখন প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মূল গণমাধ্যমে সে রকম অনেককেই দেখা যায় এবং তাদের মুখ থেকে এমন সব কথা শোনা যায়, যার অনেক কিছুর মধ্যেই থাকে প্রতিহিংসার ছাপ। এই নব্য ভাবুকদের কথাবার্তায় সামনের দিনগুলো নিয়ে কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখে। তার চেয়ে বড় কথা, যারা ১৯৭১ সালে ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মিলে বাঙালিদের হত্যা করেছিল, তাদের বিচার কেউ চাইছে না এখন। নিজেরা যে কাজগুলো করছে এবং তাদের করা সেই কাজগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের মনে কোনো প্রশ্ন জাগছে কি না, সে ব্যাপারেও তাদের অনেকেই অন্ধ থাকছে। নতুন বন্দোবস্ত শব্দ দুটি এখন অনেকের মনেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে অরাজকতা। আর তারই সুরে যদি নতুন বন্দোবস্তের কথা শুনতে হয়, তাহলে জাতির ভাগ্যে ভালো কিছু আছে বলে মনে হয় না।

অনেকের মনে পড়ে যাবে, আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে প্রেস ক্লাবে আয়োজন করা হয়েছিল একটি অনুষ্ঠান। কেন হঠাৎ করে এই জিন্নাহপ্রীতি, তা নিয়ে কি জনগণের মনে প্রশ্ন জাগেনি?

এ ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, দেশের গন্তব্য কোন দিকে। এরপর চারদিকে পাকিস্তান পাকিস্তান রব উঠেছিল। অভ্যুত্থানের নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরকে চোখেই দেখছিল না, তাদের কাছে ১৯৪৭-এর পর এসে হাজির হয়েছিল ২০২৪ সাল। এমনকি ১৯৭১ সাল যেন জাতির জন্য কিছুই নয়এ রকম একটি বার্তা দেওয়া হচ্ছিল বিভিন্ন মহল থেকে।

কিছুটা সময় পার হওয়ার পর বোঝা যাচ্ছিল, যারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, তাদের দেশ নিয়ে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না। এত দ্রুত সরকারের পতন হবে, সে রকম ধারণাও বুঝি ছিল না। ফলে তড়িঘড়ি ক্ষমতায় এসে যারা জনগণকে পথের দিশা দেখাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তাদের না ছিল পূর্বপ্রস্তুতি, না ছিল অভিজ্ঞতা। যত দিন যাচ্ছে, ততই সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতার কাহিনি প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ এমন সব কথা বলে যাচ্ছেন, যাতে মনে হয় এ দেশে নির্বাচিত সরকারের কোনো প্রয়োজন নেই। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, সময়মতো নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে একটা গড়িমসি চলবে। কয়েক দিন ধরে পদত্যাগের নাটকটি যেভাবে মঞ্চস্থ হয়েছে, তাতে অনেকেই বলছেন এটা নিজের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য ড. ইউনূসের একটি কৌশল। যে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল, তার প্রতি এই সরকার কতটা বিশ্বস্ত রয়েছে, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনীতিবিদদের অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হবে না। যে পরিবর্তন আনতে চাওয়া হয়েছে, তাতে সংস্কারের জায়গাটি আগে, এরপর নির্বাচনের ভাবনা। কিন্তু তাঁরা ঠিক করতে পারছেন না কোন কোন বিষয়ে সংস্কার করবে এবং কোন কোন সংস্কার মূলত নির্বাচিত সরকারের করা উচিত। সবকিছুই লেজেগোবরে হয়ে গেল কি না, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।

বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে অনেক কিছুই যে দ্রুত গুবলেট পাকায়, তার বহু উদাহরণ এই ৯ মাসে তৈরি হয়েছে। এখন মনে হয় এই প্রশ্ন করার সময় এসেছেএকাত্তরকে এবং একাত্তরের নায়কদের নির্বাসিত করে কি এ দেশের ইতিহাস লেখা সম্ভব? এই প্রশ্ন করার সময় এসেছে, নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য না থাকায় এই সরকারের ওপর কত দিন জনগণ বিশ্বাস ধরে রাখবে?

এবার জিজ্ঞেস করা যায়, যে জনগণকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই জনগণ আসলে কী ভাবছে, সে কথা কি এই সরকার অনুধাবন করতে পারছে? সাধারণ মানুষ তাদের জীবনযাপনে যে বিষয়টি এখন সবচেয়ে বেশি অনুভব করছে, তা হলো নিরাপত্তাহীনতা। কোনো অপরাধ ঘটলে কার কাছে যাবে তারা?

এই সময়ের একটা বড় বিপদ হলো মব সন্ত্রাস। এখানে এসে সরকার যেন স্পিকটি নট হয়ে বসে আছে। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল বাক্যটির মতো মব আসিয়া সন্ত্রাস চালাইবার পর সরকারের টনক নড়িল যেন এই মুহূর্তের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে।

জনগণ সবিস্ময়ে লক্ষ করেছে, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কারও কারও জন্য প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে দাবিদাওয়া নিয়ে অবস্থান নেওয়া কত সহজ। আবার কারও কারও জন্য একই রকম দাবিদাওয়া নিয়ে সে পর্যন্ত পৌঁছানো কতটা কঠিন। কেন এটা হয়? কেন এই পক্ষপাতিত্ব? তাহলে কি এই সরকার কোনো এক দিকে হেলে আছে? জনগণের মনে এই প্রশ্ন জাগে। কারও জন্য সাত খুন মাফ, কারও জন্য খুনহীন অস্তিত্বও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

জনগণ এ রকম প্রশ্ন করছে, করিডর দেওয়া বা বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ না করাটা এই সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত কি না। নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করা কি এতই কঠিন ছিল?

এ রকম একটা অবস্থায় সবাই জনগণের নাম করে নিজেদের ফায়দা লোটার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সব দল ক্ষমতায় এলেই জনগণকে বোকা ভাবতে শুরু করে। যে জনগণের জন্য তাদের এত ভাবনা, সেই জনগণ কী ভাবছে, সেটা কেন রাজনৈতিক নেতারা ভাবছেন না?

জনগণ আসলে কী চায়? ইনক্লুসিভ রাজনীতির কথা বলে রাজনীতির বিভাজন নিশ্চয়ই চায় না। ঘুষ-দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা করে। সবার গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় থাকুক, মনে-প্রাণে তা চায়। শিক্ষালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসুক, তা চায়। কথায় কথায় এর দোসর, ওর দোসর বলে মানুষকে নাজেহাল করার বিরক্তিকর খেলার অবসান চায়। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ নাকোচ করতে চায়। পরমতসহিষ্ণুতা চায়। রাজনৈতিক মাস্তানিকে রাজনীতি থেকে দূর করতে চায়। বাজারব্যবস্থায় সুস্থিতি চায়। কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের ন্যায্যমূল্য আদায় করতে চায়।

এ রকম আরও অনেক চাওয়া রয়েছে। জনগণ বিশাল মব নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন ঘেরাও করতে পারে না। জনগণ পরিকল্পিতভাবে যোগসাজশ করে কৌশলী খেলা খেলতে পারে না। সেই ইচ্ছাও তাদের নেই। তারা রাজনীতির এই বিশৃঙ্খল খেলা দেখতে দেখতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছে। দলবাজি, চাঁদাবাজি, মিথ্যা ইত্যাদির চাপে আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ ভরাডুবি হওয়ার আগেই জনগণ অন্তত স্বাভাবিক জীবনযাপনের গ্যারান্টি চায়।

এ দেশে একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সে-কথা দেশের জনগণের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়। সেই মুক্তিযুদ্ধকে অপমান বা অবমাননা করার হাত থেকে বাঁচাতে চায় জনগণ। সে কথা জনগণের সেবক তথা রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন

ধর্মান্ধতার শিকার প্রান্তিক নারীজীবনের কথাশিল্পী বানু মুশতাক

আইএমএফের পরামর্শ / ডলারের দাম বাজারীকরণের বিপদ

সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা

ভ্রমণপ্রেমী গভর্নরের নয় মাসে ৬৫ দিন বিদেশ সফর

বাজেটে স্বস্তি নেই মধ্যবিত্তের

কোদালিয়া গণহত্যা / নগরকান্দার রক্তঝরা ইতিহাস

১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

১০

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

১১

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

১২

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

১৩

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

১৪

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

১৫

‘ইন্টেরিম সরকার, গণহত্যার পাহারাদার’

১৬

২৮ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দিন

১৭

বাগবাটি গণহত্যা: সিরাজগঞ্জের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস

১৮

২৭ মে ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় দিন

১৯

গণ-অভ্যুত্থানগুলোর পরিণতি হতাশাজনক

২০