ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

হাসান হাফিজুর রহমানের হাতে স্বাধীনতার দলিল

দীপু মাহমুদ
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫, ০৪:১৬ পিএম
হাসান হাফিজুর রহমানের হাতে স্বাধীনতার দলিল
হাসান হাফিজুর রহমানের হাতে স্বাধীনতার দলিল

আমাদের ভালো লাগা আর গর্ব করার মতো অনেককিছু আছে। সেই অনেককিছুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র। কখনো কোনো ঘটনা আমাদের চমকে দেয়। বোধ হয় অলৌকিক। তবে তা অলৌকিক কিছু নয়, জীবনের পরম্পরা। হাসান হাফিজুর রহমানের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিল তেমন এক পরম্পরা। যেন তা পূর্ব নির্ধারিত, অনিবার্য।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু এই উপমহাদেশে নয়, পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে বিপুল বিস্ময়। পৃথিবীর মানুষ অবিশ্বাস্য বিস্ময়াভিভূত হয়ে দেখেছে বাংলার মানুষ মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে নিজ প্রাণ উৎসর্গ করেছে। অভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। স্তম্ভিত বিশ্ববাসী বাঙালিদের প্রতি নত মাথায় শ্রদ্ধা জানিয়েছে। মানুষের সংগ্রাম আর লড়াইয়ের ইতিহাস এক নতুন চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি।

পরের বছর ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদনা করলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্মসময়ের দলিল, এক ঐতিহাসিক অমর গ্রন্থ একুশে ফেব্রুয়ারি। তিনি সেখানে কবিতা লিখেছেন,

কৃষাণ যেমন বর্ষার পলিসিক্ত মাঠে রোয়া ধানের চারাগুলো

রেখে আসে সোনালী শস্যের জন্মের আকাঙ্ক্ষায়

তেমনি আমার সরু সরু অনুভূতিগুলো জনতার গভীরে বুনে এসেছি;

তাকে আমরা সবসময় জনতার সঙ্গে দেখেছি। ভাষা আন্দোলনে, মুক্তিযুদ্ধে। জনতার দাবির পক্ষে যেকোনো লড়াই-সংগ্রামে। তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন বরাবর। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পর্কে এক লেখায় মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখেছেন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই প্রথম প্রচারপত্র প্রকাশ, ১৯৫৫ সালে একুশ উদযাপন নিষিদ্ধ হলে তা অমান্য করে একুশ উদযাপন, প্রচারপত্র রচনা, ছাপানো, এমনকি বণ্টন পর্যন্ত সব দায়িত্ব তিনি তুলে নিয়েছেন নিজের ঘাড়ে। তার নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ, সওগাত এবং পাকিস্তান লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখা ও এর মুখপত্র পরিক্রমকে তিনি প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী ও কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত করেছিলেন।

প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় হাসান হাফিজুর রহমানের রাজনৈতিক সক্রিয়তার খবর পাওয়া যায়। আমরা জানি ১৯৪৬ সালে থেকে ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের কার্যক্রম বিকশিত হয়েছিল। হাসান হাফিজুর রহমান তখন সেখানে আছেন। ১৯৪৮ সালে তাকে এখানে প্রবলভাবে সক্রিয় দেখা যায়।

হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত দুটো কাজ পাশাপাশি দেখলে বুঝতে পারি তিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়, অর্থাৎ শুরু ও পরিণত অবস্থার প্রামাণিক দলিল আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন। তার প্রথমটি হচ্ছে তার সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি গ্রন্থ এবং পরেরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র। এই দুইয়ের মাঝখানে তার পেশাগত কার্যক্রম ছিল এই দুটো কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। যদিও এই কাজ দুটোর মধ্যে চরিত্রগত খানিক ব্যবধান আছে। প্রথম কাজটি সেই অর্থে ইতিহাস নয়, বলা যায় সেই সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল ঘটনার আখ্যান। আর পরের কাজটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহাসিক দলিল।

যদিও হাসান হাফিজুর রহমান তার সম্পাদিত ১৫ খণ্ডের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠার মতো দলিল ও তথ্যাদি সংগ্রহ সংখ্যার দিক থেকে বিপুল বলতে হবে। তবু আমাদের ধারণা এই যে, বহু দলিল ও তথ্য এখনো সংগ্রহের বাইরে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি লোকই কোনো না কোনোভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গ্রামে গ্রামে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বহু ঘটনার উদ্ভব হয়েছে, বহু বীরত্বগাথা, বহু ত্যাগ, বিশ্বাসঘাতকতা, অত্যাচার, নিপীড়নের কাহিনি স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে। এর পরিণাম অনুধাবণ করা কঠিন। তাছাড়া সারা বিশ্বজুড়েও ছিল এ সম্পর্কে সমর্থন ও প্রতিক্রিয়া এবং প্রবাসী বাঙালিদের ব্যাপক তৎপরতা। তাই সংগ্রহের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে তা বলা যায় না।

এখানেই আমরা দেখতে পাই একজন কবি, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক হাসান হাফিজুর রহমানকে। যিনি উত্তরপুরুষের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পূর্ণ করার এক পবিত্র দায়িত্ব।

হাসান হাফিজুর রহমান প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসবিদ নন। ঐতিহাসিক দলিল সম্পাদনার দায়িত্ব গতানুগতিকভাবে করেন ইতিহাসবিদ। কিন্তু হাসান হাফিজুর রহমানের ভেতরে ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দেশের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতা আর সচেতনভাবে ইতিহাসকে খুঁটিয়ে দেখার দৃষ্টি। যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বুঝতে যেমন সেই সময়ের প্রামাণ্য দলিল আমাদের সহায়তা করে, তেমনি সহায়তা করে সেই সময়ের প্রতিনিধিত্বশীল ঘটনার বিবিধ ইতিকথা। এখানে সময়ের প্রামাণ্য দলিল আর প্রতিনিধিত্বশীল ইতিকথা উভয়ই ইতিহাসের আধার, যা ইতিহাসকে ধারণ করে।

তিনি দেশের আপামর মানুষের আবেগ আর অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিবেচনা করেছেন। দেশের মানুষের আবেগ প্রবলভাবে তাকে স্পর্শ করেছে। সচেতনভাবে ইতিহাস লিখে রেখে যেতে চাননি। চেয়েছেন দেশের প্রতি মানুষের আবেগ, অঙ্গীকার আর আত্মত্যাগকে লিপিবদ্ধ করতে। দেশচেতনার দায় থেকে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র।

তার আশঙ্কায় বোঝা যায় এ ধরনের ঐতিহাসিক কাজে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা অত্যন্ত জটিল। বিশেষত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো কাজ সম্পন্ন করতে গেলে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ দ্বারা চালিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণকেন্দ্রিক দ্বান্দ্বিকতাও দেখা দিতে পারে। বিশেষত আমাদের মতো দেশে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে চায়। হাত ধরাধরি করে চলতে চায় ক্ষমতা ও ইতিহাস। আর তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সম্পাদনায় হাসান হাফিজুর রহমান যথাসাধ্য সতর্ক ছিলেন।

সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, আমরা ইতিহাস রচনার পরিবর্তে দলিল ও তথ্য প্রকাশকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। এর ফলে দলিল ও তথ্যাদিই কথা বলবে, ঘটনার বিকাশ ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে, ঘটনা পরম্পরায় সংগতি রক্ষা করবে।

এই কাজ যে খুব সহজ ছিল না তা বোঝা যায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা নানান বইপত্র দেখলে। বেশির ভাগ বইতে লেখক নিজে নায়ক। কিংবা ক্ষমতার কেন্দ্রে যিনি আছেন তিনি হয়ে উঠেছেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত মহানায়ক। তাতে সেসব গ্রন্থ পাঠে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে উঠেছে ক্ষমতাকে ঘিরে থাকা ব্যক্তি, দল ও সংগঠনের কৃতকর্মের দলিল। হাসান হাফিজুর রহমান বললেন, জনসাধারণই এ ধরনের ঘটনার প্রকৃত মহানায়ক।

তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ক্ষমতাবলয়ের চারপাশে ক্রিয়ারত ব্যক্তি, দল বা সংগঠনের কর্মবৃত্তান্তের দলিল সংকলন হয়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পড়লে দেখা যায় সেখানে দেশের প্রান্তজনের কথা অধিক এসেছে। সম্মুখযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাতে নিশ্চিত হওয়া যায় হাসান হাফিজুর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে জনযুদ্ধ হিসেবেই দেখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে আপামর জনগণের শক্তিকে প্রবলভাবে শ্রদ্ধা করেছেন। আর ইতিহাসে তুলে এনেছেন গণমানুষের কথা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে পটভূমি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেছেন, আমরা শুধু সেইসব তথ্য ও দলিলই পটভূমি খণ্ডে সন্নিবেশিত করার সিদ্ধান্ত নিই, যা বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডের বৈশিষ্ট্য ও এখানে বসবাসকারী জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। অর্থাৎ সেসব ঘটনা, আন্দোলন ও কার্যকারণ, এই ভূখণ্ডের জনগণকে মুক্তিসংগ্রামের দিকে উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত করেছে, প্রধানত সেসব সংক্রান্ত দলিল ও তথ্যই এই খণ্ডে কালানুক্রমিকভাবে সাজানো হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বাংলাদেশের অতীত ঘাটতে বহু দূর-অতীতে প্রত্যাবর্তন করিনি। আর তাতে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র হয়ে উঠেছে এক অসাধারণ জন-ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।

তবে হাসান হাফিজুর রহমান পাঠ থেকে আমরা জানি একুশে ফেব্রুয়ারি গ্রন্থ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র আকরের সম্পাদক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সংগঠক পরিচয় ছাপিয়ে তিনি একজন পুরোদস্তুর একজন কবি। বলা যেতে পারে তিনি আমাদের দেশের অন্যতম আধুনিক রাজনৈতিক কবি। তার কবিতায় উঠে এসেছে মানুষের অসন্তোষ, অনাচার, হাহাকার আর বিক্ষোভ। তিনি কবিতায় কারুকার্য নয়, বড় করে দেখেছেন বক্তব্যকে। নিজের লেখা কবিতা নিয়ে বলেছিলেন, আমার গন্তব্য বাস্তবতার দিকে।

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় হাসান হাফিজুর রহমানের লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ বিমুখ প্রান্তর, ১৯৬৮ সালে আর্ত শব্দাবলী, ১৯৬৯ সালে অন্তিম শরের মত, ১৯৭২ সালে যখন উদ্যত সঙ্গীন, ১৯৭৬ সালে বজ্রেচেরা আঁধার আমার, ১৯৮২ সালে শোকার্ত তরবারি, ১৯৮৩ সালে আমার ভেতরের বাঘ এবং ভবিতব্যের বাণিজ্যতরী প্রকাশিত হয়।

এবার তাকাই আপসহীন, অনমনীয়, সাহসী হাসান হাফিজুর রহমানের দিকে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭২ সাল, ১ জানুয়ারি। হাসান হাফিজুর রহমান নিযুক্ত হলেন দৈনিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। দৈনিক বাংলা সরকারি মালিকানার পত্রিকা। সেই বছর মে মাসে দৈনিক বাংলা পত্রিকার সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন হাসান হাফিজুর রহমান। দৈনিক বাংলা পত্রিকায় যোগদানের ঠিক পরের বছর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে বিস্ময়ে হতবাক করে দেওয়ার মতো এক ঘটনা ঘটে যায়। ঢাকাস্থ আমেরিকান তথ্যকেন্দ্রের সামনে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী সাধারণ মানুষের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। সেখানে পুলিশের গুলিতে দুজন মানুষ নিহত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে সেই প্রথম জনতার মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছে। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সাধারণ জনগণ।

সেদিন বিকেলেই হাসান হাফিজুর রহমান একটি বিশেষ টেলিগ্রাম প্রকাশ করেন সরকারি পত্রিকা থেকেই। সেটা মোটেও সহজ ছিল না। মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে সরকারের নির্দেশে। সেই সরকারের পত্রিকা থেকে বর্বরোচিত সেই হামলার নিন্দা জানিয়ে টেলিগ্রাম প্রকাশ ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ। পরদিন হাসান হাফিজুর রহমান দৈনিক বাংলা পত্রিকায় অমিত সাহসী সম্পাদকীয় লিখলেন- আদর্শ শাস্তি দিতে হবে। তিনি জানতেন এর পরিণতি কী হবে। তা নিয়ে চিন্তিত হননি। বরং নিজ দায় থেকে মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। আর এটিই ছিল হাসান হাফিজুর রহমানের সাংবাদিক হিসেবে লেখা শেষ সম্পাদকীয়। সরকারি পত্রিকায় সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে তাকে দৈনিক বাংলা থেকে চাকরিচ্যুত করা হলো। শেষ হয়ে গেল তার সাংবাদিক জীবন।

তবে থেমে গেল না। ১৯৭৭ সালে তাকে দেওয়া হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প-এর দায়িত্ব। তিনি বললেন, ইতিহাস লেখায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ চলবে না।

সরকার থেকে তার দেওয়া শর্ত মেনে নেওয়া হলো। মুক্তিযুদ্ধের আকরগ্রন্থের নাম চূড়ান্ত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের সেই ঘটনা ছিল এক কর্মযজ্ঞ। হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল গবেষক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে আরেক ভয়াবহ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই গবেষণা দলের একজন গবেষক, সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। তিনি বলেছেন, হাসান ভাই ছাড়া এ কাজ আর কেউ করতে পারতেন না। কারণ তার সততার অসামান্য ক্ষমতা ছিল। তার ওপর মানুষের যে আস্থা, আর কারও ওপর ছিল না। আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছি, হাসান ভাইয়ের নাম বললেই যে কারও দরজা খুলে যেত। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে আমরা কোনোদিনই পৌঁছাতে পারতাম না, কিন্তু সেখানে হাসান ভাইয়ের নাম ম্যাজিকের মতো কাজ করত। এমনই ছিল মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা।

পঞ্চাশের দশকে যখন হাসান হাফিজুর রহমান প্রকাশিত হচ্ছেন তখন তিনি লিখেছিলেন,

আমার নিয়তি তুমি, দুঃখের দারুণ মুখে

তোমাকেই রাখি বুকে, অবিরাম অনির্বান সুখে।

সেই শুরু থেকে জীবনের শেষ অবধি তিনি প্রচণ্ড প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন ক্রমাগত। কিন্তু নিজ অঙ্গীকার থেকে সরে আসেননি। মনোযোগী শ্রম আর মেধায় হয়ে উঠেছেন অনন্য। চারপাশকে গড়ে নিয়েছেন সৃজনশীলতার উর্বর মাটিরূপে।

চেয়েছিলেন প্রেম অবারিত হবে বিজয়ের ধারাজলে, রৌদ্রে, জোছনায়/ শত শতাব্দীর অবগুণ্ঠিত আশা পূর্ণ হবে। সেই চাওয়া থেকে হাসান হাফিজুর রহমানের হাতে মূর্ত হয়েছে ঐতিহাসিক যোগসূত্রে বাঁধা জীবনের প্রথম সম্পাদিত বই একুশে ফেব্রুয়ারি এবং শেষ সম্পাদিত কাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, বাংলাদেশের জন্ম ঘটনার বিকাশ ও ধারাবাহিকতা।

প্রথম প্রকাশ : খবরের কাগজ

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১৯ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক সমর্থন

বাগেরহাটের কান্দাপাড়া পৈশাচিক গণহত্যা

পাগলা দেওয়ান মসজিদ গণহত্যা

১৮ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিন ও কান্দাপাড়ার পৈশাচিক গণহত্যা

১৭ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি

১৬ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন

বাজেট ২০২৫-২৬ / বেহাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ঋণের বোঝা আরো বাড়বে

নগদের মাধ্যমে সরকারি ভাতার ১৭১১ কোটি টাকা গায়েব!

বাজেট ২০২৫-২৬ / ফরমায়েশের ঝাঁপি, বোঝা বাড়ার ভয়

বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান বৃদ্ধির নির্দেশনা নেই / শিল্প-ব্যবসায় করের বোঝা বাড়ল

১০

মূল্যস্ফীতি ও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব

১১

মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা, বাড়বে সংসার খরচ

১২

সংস্কার নাকি অপচয়? / নতুন নোটের পেছনে ২০ হাজার কোটি টাকার গল্প

১৩

৩ জুন, ১৯৭১: ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ঘটনাবলি

১৪

শহীদ বুদ্ধিজীবী / এ কে এম সিদ্দিক বিশ্বাস

১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী / কোরবান আলী

১৬

শহীদ বুদ্ধিজীবী / শান্তিময় খাস্তগীর

১৭

শহীদ বুদ্ধিজীবী / এ কে এম মনিরুজ্জামান

১৮

১০ বছরে সর্বনিম্ন বিনিয়োগ, স্থবির অর্থনীতি

১৯

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন

২০