১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা, যা স্থানীয় প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং মানবিক সংকটের জটিল সমন্বয়ে চিহ্নিত। ২৩ জুলাই ১৯৭১ তারিখে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল, যা এই সংঘাতের বহুমুখী প্রকৃতি প্রতিফলিত করে। এই প্রতিবেদনটি সেই দিনের মূল ঘটনাগুলোকে একত্রিত করে এবং সমসাময়িক বিবরণের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে।
মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা
২৩ জুলাই ১৯৭১ তারিখে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থী বিষয়ক জুডিশিয়ারি উপকমিটি, যার সদস্য ছিলেন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, হিরাম ফং এবং চার্লস মেথিয়াস, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে উদ্ভূত শরণার্থী সংকট নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করে। এই আলোচনা বাংলাদেশ সংকট নিয়ে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক উদ্বেগ এবং জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রতিফলন ঘটায়।
বক্তব্য ও উদ্বেগ
সিনেটর হিরাম ফং পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে সামরিক তৎপরতা এবং গেরিলা হামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এই কার্যক্রমগুলো পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন আর উইন ফংয়ের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, চলমান সহিংসতা শরণার্থীদের নিরাপদে ফিরে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। উইন আরও উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা ভারত গ্রহণ করেনি। তিনি ভারতের দেওয়া ৭০ লাখ শরণার্থীর হিসাবের সঠিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, জানান যে জাতিসংঘের পক্ষে এই সংখ্যা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব নয়।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশ সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান জড়িত থাকার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে এমন একটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, যা পরিস্থিতির অবনতি এড়াতে সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করা প্রয়োজন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর স্টুয়ার্ট সিমিংটন পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনি অধিকার থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সিমিংটন প্রকাশ করেন, পররাষ্ট্র দপ্তর প্রথমে দাবি করেছিল যে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পর পাকিস্তানে কোনো সামরিক সহায়তা দেওয়া হয়নি। কিন্তু পরে তারা স্বীকার করে যে অস্ত্রবাহী কিছু জাহাজ পাকিস্তানের দিকে যাচ্ছিল। তিনি আরও জানান, বারবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র প্রায় দেড় কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র পাকিস্তানে সরবরাহের অনুমতি দিতে ইচ্ছুক। সিমিংটন বলেন, “প্রশাসনকে চাপ না দেওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃত তথ্য পেশ করার কোনো চেষ্টাই করে না।”
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও অন্যান্য বিশ্ব শক্তি বাংলাদেশ সংকট নিয়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, তিনি সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের বিষয়ে সরাসরি কথা বলেছেন। ব্রান্ট বলেন, শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন নিরাপত্তা পরিষদে লেখা একটি চিঠিতে অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তানের ভারত-বিরোধী মনোভাব অব্যাহত রয়েছে। এই অভিযোগ পাকিস্তানের আগ্রাসী নীতি এবং সীমান্তে চলমান উত্তেজনার প্রতিফলন ঘটায়।
সুইডেনের স্টকহোমে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে তীব্র মতবিরোধের জেরে সুইডেনে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত ইকবাল আতাহার পদত্যাগ করেছেন। আতাহার বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান এবং অত্যাচারের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, যা ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির কারণ হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ঘটনাপ্রবাহ
পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন ২৩ জুলাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার জমি ও অন্যান্য সম্পত্তি ২৫ জুলাই নিলামে তোলার ঘোষণা দেয়। এর আগে, ৭ জুন সামরিক আদালতে তাঁদের অনুপস্থিতিতে বিচার হয়। আদালত তাঁদের ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে এবং তাঁদের অর্ধেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয়। এই পদক্ষেপগুলো পাকিস্তানি প্রশাসনের বাংলাদেশের নেতৃত্বকে দমন করার প্রচেষ্টার অংশ ছিল।
মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম
মুক্তিবাহিনী এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। কুমিল্লার মিয়াবাজারে মুক্তিবাহিনীর একটি কমান্ডো দল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায়, যার ফলে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একইভাবে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশ দল কল্যাণ সাগরের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলের ওপর আক্রমণ করে। এই হামলায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং একজন স্থানীয় দালাল নিহত হয়। এই হামলাগুলো মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত দক্ষতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের প্রমাণ বহন করে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক আইন
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সংসদে সাংসদদের উচ্ছ্বসিত সমর্থনের মধ্যে ঘোষণা করেন যে, ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘনকারী যেকোনো পাকিস্তানি বিমানকে গুলি করে নামানোর জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণা পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং ভারতের নিরাপত্তার প্রতি দৃঢ় অবস্থানের প্রতিফলন ঘটায়।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী এবং বিশিষ্ট সংবিধানবিদ সুব্রত রায়চৌধুরী কলকাতায় বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা যে বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে গোপনে বিচার করা হবে, তা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের রীতিনীতির পরিপন্থী। তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান ১৯৪৯ সালের জেনেভা চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। এই ধরনের গোপন বিচার জেনেভা চুক্তির ৩ নম্বর ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্র কলকাতায় সাংবাদিকদের জানান, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের শরণার্থী সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতের অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামোর ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছিল।
উপসংহার ২৩ জুলাই ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল, তা এই সংঘাতের জটিলতা এবং এর বিশ্বব্যাপী প্রভাবের প্রতিফলন ঘটায়। মার্কিন সিনেটে উত্তপ্ত আলোচনা, আন্তর্জাতিক নেতাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, মুক্তিবাহিনীর সাহসী প্রতিরোধ এবং ভারতের দৃঢ় অবস্থান এই সংকটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে। পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের দমনমূলক নীতি এবং শরণার্থী সঙ্কটের মানবিক প্রভাব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গুরুত্বকে আরও স্পষ্ট করে। এই ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে।
সূত্র
ইত্তেফাক, ২৫ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২৪ ও ২৫ জুলাই ১৯৭১
মন্তব্য করুন