ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫, ১ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

জয় বাংলার উচ্ছ্বাস খুঁজি

দ. ম. আহমেদ
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৬ এএম
জয় বাংলার উচ্ছ্বাস খুঁজি

❝জয় বাংলার উচ্ছ্বাস খুঁজি❞

মেজর খালেদ মোশাররফকে "আপনি আমাদের চোখ বাঁধার হুকুম দেওয়ার কে? আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে না দিলে আমরা অন্য জায়গায় যুদ্ধ করব। বাংলাদেশ কি একা আপনার?" তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করার সাহসে সমৃদ্ধ ১৪/১৫ বছরের ৮/৯ জন কিশোরের দলকে বাংলার জনপদে খুঁজি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশের এক ক্যাপ্টেনকে হত্যা করে তার ব্যাজেস অব র‌্যাঙ্ক, সাদা বেল্ট, লাল টুপি, বুট, পাউচসহ পিস্তল এনে ক্যাপ্টেন হায়দারের সামনে উপস্থাপন করে "স্যার, যুদ্ধ করে এসেছি, এবার এলএমজি দিন" বলে আবদার জানানো সামান্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন অতি সাধারণ তৈয়ব আলীকে খুঁজি।

অজানা অনুপ্রেরণায় এমন মরিয়া হয়ে ওঠা ১৪ বছরের বাচ্চু আর ৭২ বছরের ওহেদ কেরানি, একটা রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে মরণ খেলায় মেতে ওঠা গণির মতো সাধারণ মানুষদের খুঁজি।

মুকুন্দপুর শত্রু অবস্থান দখলে সায়ীদের সঙ্গী এলাকার সেজামুড়ার রফিক, সতরপুরের তাজুল (চোরাকারবারি), মোজাম্মেল (চোরাকারবারি), এলু, মোতালেব ও আরও মুক্তিযোদ্ধাসহ শত্রুর অবস্থান, কোথায় কোন অস্ত্র বসানো, কোন দিকে লক্ষ্য করে তাক করা—সব সায়ীদদের জানিয়ে দেওয়া গোয়ালনগর গ্রামের নষ্টা মেয়ে সায়রাকে খুঁজি।

"তোরা আমার বাবা-মা-ভাই-বোনদের মেরেছিস, তোরা কি মনে করেছিস আমি তোদের এমনি ছেড়ে দেব?" বলতে বলতে জয় বাংলা হুঙ্কারে একটি এলএমজি নিয়ে যুদ্ধের মাঠে শত্রুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া কিশোর সালামের নাম তার বাবা-মা-ভাই-বোনদের পাশে খুঁজি।

নীলফামারীর ছাতনাই বালাপাড়া যুদ্ধে হাতে, কোমরে আটটি গুলিতে আহত হওয়া ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আলমকে খুঁজি।

হাতিবান্ধার যুদ্ধে শত্রুর অপ্রতিরোধ্য মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড ছুঁড়ে স্তব্ধ করে দেওয়া, মারাত্মক আহত অবস্থায় ধরা পড়ে নিহত হওয়া ভুরুঙ্গামারীর গেরস্থের কামলা ছেলে খালেককে খুঁজি।

খসরু ও তার এক সহযোদ্ধার কড়া নাড়ার শব্দে "মা, এসেছে" খুশির শব্দে ময়মনসিংহের দুর্গাপুর সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর অপেক্ষায় প্রতি রাতে ভাত রেঁধে অপেক্ষায় বসে থাকা সেই কিশোরী বধূর নাম খসরুদের পাশে খুঁজে বেড়াই।

"মরদ (লোকটা) মনে হয় কী? মেবাই (মিয়াভাই) তাগড়াকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। হালার পো হালায় বেজায় হাত দিয়েছে"—সেই তাগড়াকে খুঁজি।

"আপনার যত কষ্টই হোক না কেন, শরীফের কবরটা আমাকে খুঁজে দিতে হবে। আমার জন্য নয়, নিয়াজের জন্য" কর্নেল শফির কাছে আকুতি জানানো একমাত্র সন্তান নিয়াজের মধ্যে জীবনকে খুঁজে নেওয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদ শরীফের স্ত্রীকে খুঁজি।

"দিদিমা, দিদিমা, তোমার যদি বাবা হয়, তাহলে আমার কী হবে?" জিজ্ঞাসা করা বাবা-মা হারানো শিশু মল্লিকাকে খুঁজি।

"আমার এ দেহটা কি সূতীক্ষ্ণ হাতিয়ার নয় শত্রু হননে? এ হাতিয়ার ব্যবহৃত হয়েছে লক্ষ কোটি মানুষের মুক্তির জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য। জানো, আমার এ দেহ, রূপ-লাবণ্য-লালিমার জন্য আমি গর্বিত। মুক্তিযুদ্ধে এমন হাতিয়ার দেখেছ কি? তোমার হাতের ঐ অস্ত্রটি এবং আমার এ দেহ-অস্ত্র কি একই অস্ত্র নয়? এমন একটা মুক্তিযুদ্ধ না এলে কী করে জানতাম, আমি একজন প্রিন্সেস, একটি সূতীক্ষ্ণ আবেগময় হাতিয়ার?"—সেই প্রিন্সেসকে খুঁজি।

মুক্তিযোদ্ধারা যখন মদন এলো, মিরাশের মা তখন থেকেই তাদের সঙ্গে। স্বামী, সন্তান কোথায় গেল মিরাশের মায়ের? দিনরাত এদের খাবার রান্না করেছে, এদের দেখাশোনা করেছে। আস্তে আস্তে মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার রপ্ত করে যুদ্ধে অংশ নেওয়া মিরাশের মাকে খুঁজি।

যুদ্ধে দুদিন ধরে ব্যস্ত ও না-খাওয়া যোদ্ধাদের জন্য গরু জবাই করে খিচুড়ি রান্না করে অপেক্ষা করা গ্রামবাসীদের খুঁজি।

রুমী, বদি, আলম, স্বপন, সাইদ, সিরাজ, গাজী, হানিফ, মোক্তার, মায়াদের পাশে জাহানারা ইমামকে খুঁজি।

হাজারো শেল্টার মাস্টারকে খুঁজি। শেল্টার মাস্টার এবং সশস্ত্র যোদ্ধাদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে দেওয়া সেইসব আত্মত্যাগীদের খুঁজি।

মৌলভী সৈয়দকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা লড়াকু বাহিনীর সদস্যদের খুঁজি।

"স্যার, বউ মরেছে তো কী হয়েছে। চিন্তা করবেন না। আমিই নিয়ে যাব আপনাদের শ্রীমঙ্গল"—সদ্য বউ হারিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রেইড দলের কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজকে সান্ত্বনা দেওয়া হরিকে খুঁজি।

এম্বুশের টানটান উত্তেজনার মাঝে শাড়ির আঁচলে ঢেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গামলা ভর্তি ভাপ ওঠা ভাত-তরকারি নিয়ে "বাবারা, তোমরা যুদ্ধ-টুদ্ধ যা-ই করো, আগে চটপট ভাত খেয়ে নাও। শরীরে তখন জোর হবে"—মমতার আহ্বান জানানো কুমিল্লার মুরাদনগর থানার পরমতলা গ্রামের সেই বুড়ি মাকে খুঁজি।

"দুই কোঠার ঘরের এক কোঠায় ধর্ষণ করা হলো জয়নালের স্ত্রীকে, অপর কোঠায় কিশোরী কন্যাকে"—জয়নাল, জয়নালের স্ত্রী ও কিশোরী কন্যাটিকে খুঁজি।

২৭ মার্চ সন্তান ওয়াকারকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, এলিফ্যান্ট রোডের মোড়, জগন্নাথ হল ঘুরিয়ে "কী দেখলি?", "কী করবি?" জিজ্ঞাসা করা ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল সামছুন নাহার বেগমকে খুঁজি।

"স্যার, আমাদের উনি কি ভালো যুদ্ধ করেন না? তাহলে যে স্যার, এই কয়দিন উনি বাড়িতে। আপনারা উনাকে যুদ্ধে নেন না"—তরুণ স্বামীকে যুদ্ধে পাঠানো বাহারের কিশোরী বধূকে খুঁজি।

ভেজা কাপড়ে শোকরানা নামাজ আদায় করলে পরম করুণাময় খোদাতা’আলা তা অবশ্যই কবুল করেন জেনে দূরের, কাছের, পরিচিত, অপরিচিত, নিজের, অন্যের সব যোদ্ধা-সন্তানদের রহমানুর রহিম যেন হেফাজতে রাখেন—এই বাসনায় সর্দি, কাশি, রোগবালাই অগ্রাহ্য করে নিয়ত ভেজা কাপড়ে শোকরানা নামাজ আদায় করা জহিরের মাকে খুঁজি।

আমি জয় বাংলার সেই উচ্ছ্বাস খুঁজি,

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে খুঁজি।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জয় বাংলার উচ্ছ্বাস খুঁজি

১৫ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক ঘটনাবহুল দিন

নতুন আতঙ্ক জিকা ভাইরাস : করণীয় কী?

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ভূতের আক্রমণ

মিথ্যা তথ্যের জালে নতুন প্রজন্ম!

জানুয়ারি থেকে জুন, প্রতিদিন ১১ খুন

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি: জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

১৩ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

১০

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

১১

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

১২

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

১৩

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

১৪

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

১৫

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

১৬

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

১৭

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

১৮

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

১৯

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

২০