১৫ জুলাই ১৯৭১ কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়। এই দিনে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টরের অধিনায়কেরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করেন। এই শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাত দিনব্যাপী পরিকল্পিত সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠিত প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
একই দিনে, আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এক বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর নৌ ও বিমান শাখা গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই বৈঠকে উপস্থিত সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, “বাংলাদেশের বিজয় অর্জন করতে হলে হানাদারদের বিরুদ্ধে নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া আমাদের কোনো পথ খোলা নেই। একমাত্র পথ আমাদের দেশকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে শত্রুমুক্ত করা।” এই বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার এবং যুদ্ধের তীব্রতাকে প্রতিফলিত করে।
১৫ জুলাই মোট নয়টি বামপন্থী দল বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে একটি নতুন জোট গঠন করে। এই জোটে ভাসানী ন্যাপ-সহ আটটি সমমনা বামপন্থী দল অন্তর্ভুক্ত ছিল। জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হলো: কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, শ্রমিক কৃষক কর্মী সংঘ, কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ (হাতিয়ার গোষ্ঠী), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন। জোট গঠনের পর এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত অন্য সব শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং পূর্ণ সহযোগিতা বজায় রেখে এই কমিটি সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
তবে, এই জোট গঠনের খবরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান মুজিবনগর থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, “জনযুদ্ধের এই সময় নির্বাচনে কোনো আসন না পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরনের পদক্ষেপ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং চীনকেই শক্তিশালী করবে। আমরা আশা করি সব দলের কর্মীরাই বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করে আমাদের বিজয়ের পথ সুগম করবে।” এই বিবৃতি জোট গঠনের প্রতি সরকারের সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।
ঢাকায় এই দিনে কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি শামসুল হুদা ঢাকা শহর কমিটি বাতিল করে দেন। তিনি এ এইচ মোহাম্মদ হোসেনকে সভাপতি এবং নাসির উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে নতুন কমিটি গঠন করেন। এই পদক্ষেপ পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির পুনর্গঠন এবং তাদের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাকে নির্দেশ করে।
১৫ জুলাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত একটি ঘোষণায় বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান সফর করে ফিরে গিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে দেওয়া বিশ্বব্যাংকের সব সাহায্য বন্ধ করা হোক। একইসঙ্গে ক্ষমতাধর দেশগুলো যেন পাকিস্তানকে সহায়তা না করে, সে বিষয়ে অনুরোধ করা হোক। এই মুহূর্তে যদি পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ সহায়তার জন্যে পাকিস্তানকে কোনো প্রকার সহায়তা দেওয়া হয়, তবে, তা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। বরং পাকিস্তান সরকার নিজেদের প্রয়োজনেই তা ব্যয় করবে। তাই এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে সহায়তা দেওয়া সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন।”
একই দিনে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের এক মুখপাত্র জানান, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি নতুন তালিকা পেশ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে, পূর্ব পাকিস্তানে মানবিক সাহায্য প্রেরণ অব্যাহত থাকবে। মুখপাত্র আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। তবে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো ফর্মুলার প্রস্তাব দেয়নি।
একই দিনে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি আর্থিক বছরে পাকিস্তানকে ১১ কোটি ৮ লাখ ডলার সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব করলে কমিটি ১৭-৬ ভোটে তা বাতিল করে দেয়। সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ ও উইলিয়াম স্যাক্সবির নেতৃত্বে সিনেটের প্রভাবশালী সদস্যরা পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়ার বিরোধিতা করেন এবং এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাবের প্রতি ৩২ জন সিনেটর সমর্থন জানান।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ওয়াশিংটনে এক বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তানের জন্য অস্ত্রবোঝাই জাহাজগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর থেকে ছাড়তে দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যাখ্যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। তিনি কম্পট্রোলার জেনারেল এলমার স্ট্যাটনকে এই ঘটনার অনুসন্ধান করার অনুরোধ জানান। খবর ছিল, পদ্মা নামে একটি জাহাজ পাকিস্তানের জন্য সমরসামগ্রী বহন করে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোরে পৌঁছায়। ১৪ জুলাই জাহাজটি বাল্টিমোরে এসে পৌঁছালে কয়েকজন বন্দরে নৌকায় করে জাহাজটি থামানোর চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর কর্মী ইউনিয়ন পদ্মায় কোনো সামগ্রী না তোলার জন্য বন্দর কর্মীদের অনুরোধ জানায়।
ওয়াশিংটনে এই দিনে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান। হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, “ভারত এখন পাকিস্তানের নামে পুরো বিশ্বে কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে, একইসঙ্গে মিথ্যাচার প্রচার করছে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আছে। সেখানে আমাদের সামরিক বাহিনী বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে কঠোর হস্তে দমন করছে।” এই বক্তব্য পাকিস্তানের প্রচারণা এবং তাদের অবস্থানকে সমর্থন করার প্রচেষ্টার অংশ ছিল।
১৫ জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রেমলিনে ভারতের সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ওম মেহতা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাগদার নাসসুদ্দনোভার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই বৈঠকে ওম মেহতা পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের অবস্থা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানান। বাগদার নাসসুদ্দনোভা বলেন, “এই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সোভিয়েত সরকার বিবেচনা করছে। এই মুহূর্তে আমরা কোনোভাবেই পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা বা অস্ত্র বিক্রি করতে পারি না। পাকিস্তান সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না পূর্ব বাংলার বিষয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধানে আসতে পারবে এবং শরণার্থীদের নিরাপদে স্বদেশে ফেরত না নিতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা পাকিস্তান সরকারের বিষয়ে কোনো প্রকার সম্পর্ক স্থাপন করবো না।” এই প্রতিশ্রুতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইসলামাবাদে এই দিনে পাকিস্তান সরকারের এক সরকারি মুখপাত্র জানান, পাকিস্তান সরকার কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। একটি সরকারি হ্যান্ডআউটে বলা হয়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ব্রিটেনের আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সংগত কি না, তা বিবেচনা করা হচ্ছে। এছাড়া, ব্রিটেনের নজির অনুসরণ করে কমনওয়েলথের আরও কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের ব্যাপারে অবাস্তব মনোভাব গ্রহণ করেছে, যা ক্ষেত্রবিশেষে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল হয়ে উঠেছে।
ভারতের বিখ্যাত দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান ১৫ জুলাই এক প্রতিবেদনে জানায়, আইরিশ এমপি স্যার এন্থনি এজমন্ড ও উইলিয়াম লোগান কলকাতায় এক প্রেস কনফারেন্সে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে ৭ মিলিয়ন শরণার্থীর ভারতে অনুপ্রবেশ দেশটির অর্থনীতিতে একটি ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।” এই প্রতিবেদন শরণার্থী সংকটের তীব্রতা এবং এর আঞ্চলিক প্রভাবের উপর আলোকপাত করে।
একই দিনে দৈনিক যুগান্তর-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধারা নাভারন ও জিকরগাছা দখল করে নিয়েছে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসীকে পাকিস্তানি সেনারা আগেই হত্যা করেছে, এবং বাকিরা আশ্রয়ের জন্য ভারতে চলে এসেছে। পাকশি সেতুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বেকায়দায় পড়েছে। কুষ্টিয়া জেলার কয়েকটি গ্রাম মুক্তিফৌজ দখল করে নিয়েছে, এবং পাকশি সেতুর এক প্রান্তে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। মুক্তিফৌজের মতে, এই অঞ্চলে অন্তত দুই শতাধিক কমান্ডো সক্রিয় রয়েছে।
১৫ জুলাই টাঙ্গাইলের কালিহাতির বল্লায় কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৬০ সৈন্যের ওপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৫১ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। সকালে মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক থেকে হানাদার সৈন্যদের ঘেরাও করে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করে। এই সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং পালানোর চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনীর গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে একটি দল পেছন থেকে তীব্র গোলাগুলি শুরু করে। এদিকে, অবরুদ্ধ হানাদার সেনাদের উদ্ধারে নতুন একটি সৈন্যদল নৌকায় করে বল্লার দিকে আসার পথে চারান নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলার শিকার হয়। হতবিহ্বল হানাদার সেনারা নৌকায় ছোটাছুটি করলে নৌকা ডুবে যায়, এবং বেশ কয়েকজন সৈন্য পানিতে ডুবে মারা যায়। বাকি সৈন্যরা তীরে উঠে বল্লার দিকে রওনা হলে অবরুদ্ধ হানাদার সেনারা তাদের মুক্তিযোদ্ধা মনে করে গুলি ও মর্টার শেলিং শুরু করে, ফলে আরও কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
সন্ধ্যায় নতুন আরেকটি হানাদার সৈন্যদল বল্লার দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল আগে থেকে আত্মগোপনে থাকায় এই নতুন দলের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তিন দিক থেকে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়, এবং কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখেও দোর্দণ্ড প্রতাপে এগিয়ে যায়। অবশেষে হানাদার সেনারা অবরুদ্ধ সৈন্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। দুই দিনের এই যুদ্ধে প্রথম দিনেই ৫১ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
একই দিন সিলেটের শাহবাজপুরে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর গেরিলা হামলা চালায়, যাতে ১৩ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। এই গেরিলা অভিযান মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত দিকগুলোর শক্তি প্রদর্শন করে।
কুষ্টিয়ায় এই দিনে এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর অস্থায়ী আমীর মিয়া তোফায়েল বলেন, “এক ব্যক্তি এক ভোট নীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চিরদিনের জন্য পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। কিন্তু, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ক্ষমতা দখল করে দাবি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বাঙালিদের এক চিরস্থায়ী দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।” এই বক্তব্য পাকিস্তানপন্থী শক্তির প্রচারণার অংশ ছিল।
একই দিনে কুষ্টিয়া জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাদ আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, “ভারতের চর দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচাতে হবে দেশকে। এজন্য রাজাকারদের সর্বসময় সজাগ থাকতে হবে। একইসঙ্গে মীর জাফর দুষ্কৃতিকারীদের উৎখাত করে জনসাধারণের মধ্যে মনোবল সুদৃঢ় করতে হবে। আমরা দেখেছি বিপুল সংখ্যক দেশপ্রেমিক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। রাজাকাররা ইতিমধ্যে বহু অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে ও দুষ্কৃতকারী দমন করেছে। সবার দায়িত্ব এখন প্রাণের বিনিময়ে হলেও অখণ্ড পাকিস্তানকে রক্ষা করা।” এই বিবৃতি পাকিস্তানি শাসনের সমর্থনে রাজাকারদের ভূমিকাকে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টার প্রতিফলন ঘটায়।
এই দিনে অবরুদ্ধ বাংলাদেশ সফররত কানাডার একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম শহরের প্রধান বৌদ্ধমন্দির পরিদর্শন করে এবং চট্টগ্রাম ক্লাবে ব্রিটিশ নাগরিক ও কানাডার মিশনারিদের সঙ্গে আলোচনা করে। এরপর তারা শহরের কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে ঢাকায় ফিরে করাচির পথে রওনা দেন।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র তৃতীয়, পঞ্চম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর চার
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৬ জুলাই ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ জুলাই ১৯৭১
ইত্তেফাক, ১৬ ও ১৭ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৬ ও ১৭ জুলাই ১৯৭১
মন্তব্য করুন