১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি রূপান্তরকারী অধ্যায়। ১৭ জুলাই ১৯৭১ তারিখে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে আরও জোরদার করেছিল। এই দিনটি মুক্তিবাহিনীর অদম্য সংগ্রাম, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান সচেতনতা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর জটিল ভূমিকাকে তুলে ধরে। এই প্রতিবেদনটি সেই দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করে, যা প্রাথমিক সূত্রের ভিত্তিতে সংকলিত হয়েছে।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ঘটনাবলি
নিক্সনের প্রস্তাবিত চীন সফরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
১৭ জুলাই ১৯৭১, মুজিবনগরে অবস্থিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রস্তাবিত চীন সফর নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বড় শক্তিগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া বা রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের ফলে শান্তিকামী ছোট দেশগুলোর গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় স্বাধীনতার স্পৃহা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যে যেকোনো পরিবর্তন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বৈধতাকে ক্ষুণ্ন করবে না। এই বিবৃতি অস্থায়ী সরকারের আশঙ্কাকে প্রতিফলিত করে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তনের প্রভাব এবং তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল।
একই বিষয়ে, ভারতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম হোসেন আলী কলকাতায় বলেন, নিক্সনের চীন সফর বিশ্বশক্তির ভারসাম্য পরিবর্তন করতে পারে, যা ছোট রাষ্ট্রগুলোর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তবতা, এবং মুক্তিবাহিনী যুদ্ধে জয়ী হবেই। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বিষয়ে যেকোনো সমাধান শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমেই সম্ভব, যিনি তখন কারারুদ্ধ ছিলেন। এই বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে শেখ মুজিবের অপরিহার্য ভূমিকার ওপর জোর দেয়।
জাতিসংঘের স্বীকৃতির জন্য আহ্বান
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একই দিনে দিল্লিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বাংলাদেশে ত্রাণকার্য বা শরণার্থী তদারকির জন্য জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার প্রস্তাবকে “দুরভিসন্ধিমূলক” বলে নিন্দা করেন। তিনি যুক্তি দেন, জাতিসংঘের যেকোনো বৈধ সম্পৃক্ততার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি প্রথম শর্ত। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানান, এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তাঁর ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সংহতি
অ্যালেন গিন্সবার্গের সহায়তা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ সহায়ক কমিটির কাছে ২০০ ডলারের একটি চেক পাঠান, যা এই দিন কমিটির হাতে পৌঁছায়। চেকের সঙ্গে তিনি একটি চিঠিও পাঠান, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা এবং পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রবোঝাই জাহাজ প্রেরণের বিরুদ্ধে জনমত এখনো ততটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। তিনি উল্লেখ করেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতায় যুক্তরাষ্ট্রবাসী এতটাই ব্যস্ত যে বিশ্বের অন্য দেশে চলমান অন্যায়-অবিচারের দিকে তাকানোর সময় তাদের হচ্ছে না। তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
যুক্তরাজ্যের উদ্বেগ
যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম কমিটির একজন মুখপাত্র লন্ডনে সাংবাদিকদের জানান, তারা আশঙ্কা করছেন যে ইরান ব্রিটিশ কারখানায় ট্যাঙ্কের যে ক্রয়াদেশ দিয়েছে, তা সম্ভবত পাকিস্তানের হাতে চলে যাবে। অথবা ইরান পাকিস্তানকে ইতিমধ্যে দেওয়া অস্ত্রের পরিবর্তে এই নতুন অস্ত্র পাঠাতে পারে। এ বিষয়ে কমিটির নেতারা ব্রিটিশ সরকার এবং লন্ডনের ইরানি দূতাবাসের সঙ্গে আলোচনার কথা ভাবছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের বাল্টিমোর ডক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত পাল্টে ঘোষণা করেন, পাকিস্তানগামী জাহাজে অসামরিক মালপত্র তুলতে তারা রাজি। আন্তর্জাতিক বন্দর কর্মী সমিতির স্থানীয় ইউনিটের প্রথম সহ-সভাপতি চার্লস জোনস বলেন, তারা ভেবেছিলেন জাহাজে অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিন্তু আসলে তা নয়।
ভারতের শরণার্থী সংকট
ভারতের কেন্দ্রীয় শ্রম ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আর কে খাদিলকর জানান, বাংলাদেশ থেকে এক কোটি শরণার্থী আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে শরণার্থীদের জন্য খরচ আরও বাড়বে, যেখানে প্রশাসনিক খরচ ধরা হয়নি।
ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ বি কিটিং পশ্চিমবঙ্গের সল্টলেক ও বারাসাতে তিনটি শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন। শরণার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং মুখ্য সচিব এন বি সেনগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বেইজিং সফরের সিদ্ধান্তটি সময়োপযোগী।
মুক্তিবাহিনীর সামরিক অভিযান
১৭ জুলাই ১৯৭১, মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে সাহসী অভিযান চালায়, যা তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের শক্তিশালী উপস্থিতি প্রদর্শন করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিযান
মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শালদা নদী রেলস্টেশনের দক্ষিণে মনোরা রেলসেতুর কাছে মর্টারসহ পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। গুলির মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের শালদা নদী ঘাঁটিতে ফিরে যায়। এছাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা লাতুমুড়া থেকে চন্দ্রপুর যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করে, যাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
কুমিল্লায় আক্রমণ
কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কে পুটিয়া গ্রামের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কের আশিকাটি গ্রামের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এছাড়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি দল হাজীগঞ্জের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর নরসিংপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের অবস্থানে ফিরে যান।
রাজশাহীতে প্রতিরোধ
উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী জেলার শাহপাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর আক্রমণ চালায়, যাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
১৭ জুলাই ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনাবহুল দিন, যেখানে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক কার্যক্রম একত্রিত হয়ে এই সংগ্রামের গতিশীলতা প্রকাশ করে। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযানগুলো এই দিনের ঘটনাবলির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অদম্য চেতনা এবং বিশ্বব্যাপী এর প্রভাবের প্রমাণ বহন করে।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও সাত
ইত্তেফাক, ১৮ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৮ ও ১৯ জুলাই ১৯৭১
মন্তব্য করুন