১৬ জুলাই ১৯৭১ রাত ৯টার দিকে, মুক্তিবাহিনীর বিশেষ গেরিলা ইউনিট ক্র্যাক প্লাটুনের ছয়জন সদস্য ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত শহরের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রে একটি সাহসী অভিযান শুরু করে। ২০ পাউন্ড প্লাস্টিক বিস্ফোরক, ডেটোনেটর এবং ফিউজ নিয়ে সজ্জিত এই গেরিলারা একটি সুপরিকল্পিত আক্রমণ পরিচালনা করে। তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রের গেটে মোতায়েন পুলিশ ও গার্ডদের ফাঁকি দেওয়া এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া।
গেরিলারা এরপর গার্ডদের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে চাবি ছিনিয়ে নেয় এবং অন্য গার্ড ও পুলিশদের গুরুত্বপূর্ণ কক্ষগুলো দেখাতে বাধ্য করে। এই সময় ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা ১৭ জন পুলিশকে বন্দি করে এবং অপারেটরকে ট্রান্সফরমার রুমে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। ট্রান্সফরমার রুমে বিস্ফোরক স্থাপন করে তারা ট্রান্সফরমারটি উড়িয়ে দেয়। এই সাহসী অভিযান পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসনের অবকাঠামোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং ঢাকার কেন্দ্রস্থলে মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত আক্রমণের সক্ষমতা প্রদর্শন করে।
১৬ জুলাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে এক সমাবেশে বক্তৃতা দেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা তুলে ধরে বলেন, “আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা পরাজিত হওয়ার জন্য রণক্ষেত্রে অস্ত্রধারণ করেনি। তারা জয়লাভের জন্যই অস্ত্র হাতে নিয়েছে। জয় আমাদের হবেই।” তিনি বিশ্ব জনমতের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিশ্বের জনমত বাংলাদেশের পক্ষে, এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অবশ্যম্ভাবী।
সৈয়দ নজরুল ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, “ভারত আমাদের ৬০-৭০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আমাদের দাবির ন্যায্যতা স্বীকার করে স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমি ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
একই দিনে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন একটি বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ঘোষণা দেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল বারীকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং জয়দেবপুরের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. আমিরুল ইসলামকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগগুলো যুদ্ধের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার প্রচেষ্টার অংশ ছিল।
রাজশাহীতে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আজম এক সমাবেশে বলেন, “পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রবিরোধীদের নির্মূল করতে দেশপ্রেমিক জনগণকে একত্রিত করতে হবে।” তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল বলে অভিযোগ করে বলেন, “ভারত যদি এই দেশ দখল করে, তবে তাদের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা লাভ করা কীভাবে সম্ভব?”
বরিশালে শান্তি কমিটির এক সভায় মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন আহমদ বলেন, “ভারতের দালাল দেশদ্রোহী মুক্তিবাহিনীকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনোই তা হতে দেবে না।”
টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বল্লায় আটকে পড়া সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পাঁচটি নৌকায় সৈন্য ও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা অতর্কিত হামলা চালায়। এই আক্রমণে হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে, এবং বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে তিনটি নৌকা ডুবে যায়। এই সময় বল্লায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনী পলায়নরত সৈন্যদের মুক্তিযোদ্ধা ভেবে গুলি ও মর্টার শেলিং করে, ফলে তাদের নিজেদের মধ্যে ব্যাপক হতাহত হয়।
একই দিন সন্ধ্যা ৫টা ৪৫ মিনিটে আরেকটি পাকিস্তানি সৈন্যদল নৌকায় করে বল্লার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী তাদের উপর গুলি চালায়। মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি হামলা চালালে হানাদারদের সব নৌকা ডুবে যায়। এই দিন কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে বহু হানাদার সৈন্য আটক হয়। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকীর নির্দেশে ৩১ বেলুচ সৈন্য ঢাকা থেকে এনে আর্টিলারি ফায়ার করা হয়, কিন্তু আটককৃত সৈন্যদের মুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
মুন্সিগঞ্জে শান্তি কমিটির সদস্য খলিলুদ্দিন শিকদার মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অভিযানে নিহত হন, যা পাকিস্তানি শাসনের সহযোগীদের নেটওয়ার্ককে আরও দুর্বল করে।
নওগাঁর রাণীনগরের তিলাবুদু গ্রামে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ওহিদুর রহমান ও আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে দুটি দল পাকিস্তানি হানাদারদের আগমনের খবর পেয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় হানাদারদের দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং চারজন সৈন্য নিহত হয়।
রাজশাহীর গোগরা বিলে রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই নির্মম আক্রমণে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, এবং আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হককে আটক করে হানাদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে রাজাকার কমান্ডার আলমাস আলীর নেতৃত্বে একটি রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়, যা পাকিস্তানি প্রশাসনের মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ দমনের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করে।
কলকাতা বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং বলেন, “পূর্ব বাংলার শরণার্থীরা কেবল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন।” আসামে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পর তিনি কলকাতায় আসেন এবং তিন দিন ধরে বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি, বলেন যে দিল্লিতে ফিরে বিস্তারিত জানাবেন।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান মতিউর রহমান ঘোষণা করেন, পাকিস্তানি সামরিক সরকারের লাভ রোধ করতে পাঁচ লাখ গাঁট কাঁচা পাট আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির জন্য ক্রেতা খোঁজা হচ্ছে। চা এবং তামাক বিক্রি করে পাকিস্তান যাতে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করতে না পারে, সেজন্যও সরকার ব্যবস্থা নেবে।
রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, তিনি শীঘ্রই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তিনি বলেন, “দেশ এখন গভীর সংকটে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা উদ্বেগজনক।”
১৬ জুলাই গুজব ছড়ায় যে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তান থেকে গোপনে চীনের রাজধানী বেইজিং সফর করেছেন। পাকিস্তানে তিনি অসুস্থ বলে প্রচার করা হলেও তিনি গোপনে বেইজিং যান। এই সফরে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনেক কূটনীতিককে বিস্মিত করে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর নিশ্চিত করে যে বাল্টিমোরে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মায় বিমানের যন্ত্রাংশ, সামরিক যান, আর্টিলারি সরঞ্জাম এবং ১২ লাখ ৩১ হাজার ৩৮ ডলার মূল্যের গোলাবারুদ বোঝাই করতে ডকশ্রমিকরা অস্বীকার করেছে।
লন্ডনে ব্রিটিশ বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটি চীনের দূতাবাসের সামনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এরপর তারা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে আরেকটি স্মারকলিপি প্রদান করে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনারের আলোচনায় ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয়। পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহি বলেন, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে পাকিস্তান প্রস্তুত এবং তাদের জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের নিরাপত্তা দেবে। উত্তরে ভারতীয় প্রতিনিধি নটরাজন কৃষ্ণণ বলেন, “গণহত্যা এবং জনপদ পোড়ানোর জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনই দায়ী। শরণার্থীরা প্রাণের ভয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের ফিরতে হলে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যা পাকিস্তান করবে না।”
সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জা রুবেজম পত্রিকায় “ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি বড় বোঝা” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, পাকিস্তানে চার মাস ধরে চলমান সংকটের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের লাখো মানুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং বিহারে আশ্রয় নিয়েছে। শরণার্থীর সংখ্যা মে মাসে ৩.৫ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৬ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। তারা খড়ের কুঁড়েঘর বা খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। মহামারির ঝুঁকি দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কলেরা ছড়িয়েছে, যদিও প্রথম তরঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী ছয় মাসে শরণার্থীদের জন্য ভারতের তিন বিলিয়ন রুপি প্রয়োজন, যা জাতীয় বাজেটে চাপ সৃষ্টি করবে। সোভিয়েত সরকার ভারতের অনুরোধে ৫০ হাজার টন চাল সরবরাহ করেছে।
বিবিসির সংবাদদাতা মার্ক টালি জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে শীঘ্রই পশ্চিম পাকিস্তানে বিচারের মুখোমুখি করা হতে পারে, তবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, তৃতীয়, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ জুলাই ১৯৭১।
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৭ জুলাই ১৯৭১।
দৈনিক যুগান্তর, ১৮ জুলাই ১৯৭১।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য, আবদুল মতিন, সাহিত্য প্রকাশ।
ইত্তেফাক, ১৭ ও ১৮ জুলাই ১৯৭১।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৭ ও ১৮ জুলাই ১৯৭১।
মন্তব্য করুন