ঢাকা শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৪ আশ্বিন ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন

​​​​​​​শাহাব উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ০৭:২৪ পিএম
২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন

১৯৭১ সালের ২০ জুলাই দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় বক্তৃতাকালে বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা। তিনি বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। একটি দেশের রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানের বিচার করার অধিকার অন্য কোনো রাষ্ট্রের নেই।’

সকাল ৯টায় এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর ইয়াকুবপুর, চন্দ্রপুর ও বাগাবাড়ি অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে।

সকাল সাড়ে ১০টায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল কুমিল্লা শহরে পাকসেনাদের বিভিন্ন অবস্থানের ওপর মর্টার আক্রমণ চালায়। একটি গোলা আজাদ স্কুলে, একটি গোলা সাধনা ঔষধালয়ের কাছে, একটি গোলা গোয়ালপট্টিতে, একটি গোলা কালীবাড়ির কাছে ও একটি গোলা এসডিও অফিসের কাছে বিস্ফোরিত হয়। গোলা বিস্ফোরণে পাকসেনাদের মনোবল ভেঙে যায় এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারা কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে ছোটাছুটি শুরু করে।

বগুড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সার্কিট হাউস ক্যাম্পের ওপর বোমা হামলা চালায়। এতে একজন পাক প্রহরী নিহত হয়। রাজশাহী শহরে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দল পাকবাহিনীর একটি টহলদলকে ফুদকিপাড়ায় অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। মেজর গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল লালপুর থানা রেইড করে। এতে ৭ জন অবাঙালি পুলিশ নিহত হয়।

সিলেটে ক্যাপ্টেন হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল পাকবাহিনীর দিলকুশা চা বাগান ঘাঁটি আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পথপ্রদর্শক শহীদ হন এবং ক্যাপ্টেন হক ও মুক্তিযোদ্ধা বাবু আহত হন। মুক্তিবাহিনী এবং পাকসেনাদের মধ্যে থাকুইরার রণাঙ্গনে দিনব্যাপী এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই দিনের যুদ্ধে পাক বর্বর বাহিনী সবচেয়ে বেশি মর্টার শেলিং করে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনাকে হত্যা করেন। পরিশেষে দখলদার বাহিনী দাঁতভাঙা জবাব পেয়ে সেদিন পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এই দিন হানাদার বাহিনী নাটোর জেলার লালপুরের রামকৃষ্ণপুর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে এবং আবদুল মন্ডল, বক্স, তাছের মোল্লা, কলি এবং মোজাম্মেলকে হত্যা করে। বিলমাড়িয়া হাট ঘেরাও করে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে ৫০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করে এবং গোপালপুর থেকে ধরে আনা ২২ জন যুবককে লালপুর নীলকুঠির কাছে হত্যা করে, কয়েকজনকে জীবন্ত কবর দেয়। ডেবরপাড়ার নুরুল ইসলাম মেম্বারকে শান্তি কমিটির বিরোধিতা করার কারণে লালপুর হাইস্কুল মাঠে গুলি করে হত্যা করা হয়।

লাহোরে পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে এখানে-সেখানে কিছু বিস্ফোরণ ঘটছে কিংবা সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলি চলছে, যা মোটেই সহনীয় নয়। কিন্তু তাই বলে পুরোপুরি স্বাভাবিকতা ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বশর্ত হতে পারে না। তার দল ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আর তিন মাস ধৈর্য ধরবে, এর বেশি নয়।

কাউন্সিল মুসলিম লীগ সভাপতি মিয়া দৌলতানা বলেন, তার দল পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিনিময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী নয়। তার দল দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যাপারে সরকারের যেকোনো পদক্ষেপকে স্বাগত জানাবে।

ইসলামী সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টেঙ্কু আবদুর রহমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ইসলামাবাদে সাক্ষাৎ করেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে ডাবলিন থেকে প্রকাশিত ‘আইরিশ টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধের বরাত দিয়ে বলা হয়, ইয়াহিয়া তার বেতার ভাষণে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন বা রাজনৈতিক রদবদলের প্রস্তাব করেছে তা জঘন্য। ইয়াহিয়া তার বেয়নেট-উদ্যত সেনাবাহিনী দিয়ে আটক দেশবাসীর উদ্দেশে যে বক্তৃতা করেছে, তাতে তার দেশ গোল্লায় যাবে। বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সেনাবাহিনীর অত্যাচারে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, তারা কেউই এ প্রস্তাবে দেশে ফিরে আসতে পারে না।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রথম প্রকাশ: জনকণ্ঠ, ২০ জুলাই ২০১৯

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বান্দাইখাড়ায় শতাধিক নিরীহ মানুষকে ব্রাশফায়ারে হত্যা

OMR পদ্ধতিতে ডাকসুর নির্লজ্জ ডিজিটাল কারচুপি

১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: গণহত্যা, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও প্রতিরোধের অমর গাথা

১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: কসবায় মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে ২১ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত

১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: কসবায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ২০১ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত

১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ১৫ দিনের মধ্যে আনুগত্য প্রকাশের নির্দেশ প্রবাসী সরকারের

হাসনাবাদ গণহত্যা: লাকসামের অমানবিক অধ্যায়

পোমরা গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের এক অমানবিক অধ্যায়

১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক

১০

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

১১

কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর)

১২

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ভুটানের রাজার শরণার্থীশিবির পরিদর্শন, অপ্রত্যাশিত সমর্থন

১৩

শোভনা গণহত্যা (খুলনা)

১৪

উদয়পুর গণহত্যা (মোল্লাহাট, বাগেরহাট)

১৫

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ

১৬

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন

১৭

ঘোড়াইল গণহত্যা (কেন্দুয়া, নেত্রকোনা)

১৮

৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক চাপ এবং গেরিলা অভিযানের দিন

১৯

কাঁঠালতলা গণহত্যা (ফকিরহাট, বাগেরহাট)

২০