(১)
কৈশোরে আমরা একটা কথা খুব বলতাম, 'মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়'। কথাটা আমি প্রথম লিখেছিলাম ১৯৮০ সনে, সম্ভবত 'ঐতিহ্য' নামে আমাদের যে অনিয়মিত প্রকাশনাটা ছিল, সেটার সম্পাদকীয়তে, কুমিল্লায়। অথবা হয়তো কোনো লিফলেটেও লিখে থাকতে পারি, স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে সনটা যে ১৯৮০ সনে ছিল আর জায়গাটা যে কুমিল্লা সেটা স্পষ্ট মনে আছে। আমাদের তালপুকুরের পাড়ের সেই ভাঙা এক ঘরের ছোট অফিসটায় বাকের ভাইয়ের মুখে কথাটা শুনে খুব ভালো লেগেছিল, তারপর সেটা আমি অ্যাডপ্ট করে নিয়েছিলাম। ফেসবুকে এই কথা যে কতবার বলেছি!
কথাটা কি সত্যি নয়? আপনি মানুষের গর্ভে জন্মেছেন, মানুষ আপনাকে মায়ের পেট থেকে টেনে বের করেছে, এরপর সারাজীবন আপনার যতরকম যা যা সহযোগিতা লাগে সবই আপনাকে মানুষই করেছে, এবং শেষ বিদায়ের দিন মানুষই আপনাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবে। এমনকি আপনি যদি ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন, লক্ষ্য করবেন ঈশ্বরও কখনো নিজে এসে আপনাকে কোনো সহযোগিতা করেন না- তিনি আরেকজন মানুষকেই পাঠান আপনার কাছে। সেই মানুষ আপনার বিপদে আপনার হাত ধরে আপনাকে রক্ষার চেষ্টা করে। মানুষ ছাড়া মানুষ কার কাছে যাবে! কেউ নেই।
এইসব কথা আজ আবার কেন বলছি? নরেন্দ্রভাই মোদী ও ভারত সরকারের ভূমিকা দেখে। যেদিন মাইলস্টোনের ঘটনাটি ঘটে, সেদিনই মোদী টুইট করেছিলেন আমাদের শিশুদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এবং সেই টুইটেই তিনি বলেছিলেন যে বাংলাদেশের জন্যে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ভারত করবে। টুইট পড়ে ভালো লেগেছিল, কিন্তু তখন ভেবেছিলাম দুই দেশের সম্পর্ক যে পর্যায়ে নেমেছে, বাস্তবে কোনো সহযোগিতা বা সেরকম কিছু সম্ভবত হবে না। গতকাল রাতে দেখি ভারতীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আর নার্সদের একটা ছোট দল ঠিকই ঢাকায় এসে পৌঁছেছে।
(২)
ভালো লেগেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে ওরা বলেছেন যে এই দলটা প্রাথমিকভাবে রোগীদের দেখবে, পরিস্থিতি দেখবে এবং আরও চিকিৎসক বা অন্য যা কিছু দরকার সেটা এই ডাক্তাররা জানালে ভারত সরকার আরও ডাক্তার বা চিকিৎসা সামগ্রী যা যেরকম যা কিছু দরকার সেগুলি পাঠাবে। না, ভারতীয় ডাক্তার নার্স বা ওদের সরকারের কোনো সহযোগিতা না হলেও নিশ্চয়ই আমাদের ডাক্তাররা ঠিকঠাক চিকিৎসা করতে পারবেন। প্রয়োজনে গুরুতর আহতদের আমরা বিদেশেও পাঠাতে পারি। তথাপি, ওরা যে এসেছে, আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, এটা তো একটা চমৎকার ব্যাপার আরকি।
তরুণদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই- এই বাংলাদেশে একবার ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে আমরা খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। উপকূলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়- তছনছ হয়ে যায় সন্দ্বীপ, উড়িরচর ঐসব এলাকা। যেদিন ঘূর্ণিঝড়টা হলো, তার পরের দিনই নানারকম ত্রাণ সহায়তা নিয়ে ভারতীয় বিমানগুলি আসতে শুরু করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, শুধু ত্রাণ নয়, ত্রাণের সাথে চলে এসেছিলেন ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে। কে সেই লোক বলো তো? ইন্দিরা গান্ধীর সুপুত্র শ্রীমান রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধী কিছু কেবল ঢাকায় বসে থাকেননি- তিনি চলে গিয়েছিলেন দুর্গত এলাকায় ত্রাণকার্যে।
বয়স্ক যারা ওদের মনে থাকার কথা, রাজীব গান্ধী কাঁধে করে গমের বস্তা চালের বস্তা নামাচ্ছেন, আমাদের ড. কামাল হোসেন নৌকো থেকে বস্তা নামাচ্ছেন কাঁধে করে। মনে আছে আপনাদের? শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলের নেত্রী, বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী- ওরা দুজনেই সন্দ্বীপে ছিলেন কয়েকদিন। আপনি ভাবুন তো দৃশ্যটা- বাংলাদেশের সকল বড় বড় নেতারা, সকল রাজনৈতিক কর্মীরা, সকল বিভেদ ভুলে একসাথে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে- ওদের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও দাঁড়িয়েছেন আমাদের দুর্গত মানুষের জন্যে। ঐ কথাটা, মানুষ মানুষের জন্যে, এর চেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ তো খুব একটা হয় না আরকি।
(৩)
ভারতকে আমরা গালাগালি করি- না, ভারতের প্রতি বৈরিতা পোষণের কিছু কারণও তো আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ঐসবের উপরেও এই কথাটা সত্যি- মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়, আর মানুষ মানুষেরই জন্য। আর মানুষের মনুষ্যত্ব কখনো ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক সীমানা দিয়ে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না- ধর্ম রাজনীতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এইসব দিয়ে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ নিশ্চয়ই তৈরি করা যায়, কিন্তু সেইটা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নয়, মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম হচ্ছে প্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও আস্থা। ভুল করবেন না, সকল মানুষই প্রেমময়।
কেননা আমরা সকলেই জানি, আমরা যখন বিপন্ন হই, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি বটে, কিন্তু আমাকে যারা উদ্ধার করে ওরা কেউ ঈশ্বর নয়, দেবতা নয়, দেবদূতও নয়- মানুষ। নিতান্ত রক্তমাংসের দশ গুণ লোভ ঈর্ষা কাম ক্রোধ সেইসব মিলিয়ে একশো একটা ত্রুটিযুক্ত নশ্বর মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়।
মন্তব্য করুন