শেখ হাসিনা সরকার লুটেরাদের পাহারাদার/পুঁজিবাদের পাহারাদার। এই শ্লোগানে বাছাল (বামে দীক্ষিত কিন্তু ছাগাদর্শে বিশ্বাসী) রেজিম চেঞ্জের মিছিলে অংশ নিয়েছে। অবশ্যই শেখ হাসিনার সরকার পুঁজিবাদের সরকার, এ নিয়ে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই। একই সাথে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী—এটি নিয়েও খুব বেশি দ্বিমতের জায়গা নেই।
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ালো, এই সরকারটিকে সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা পুঁজির মালিকরা ফেলে দেওয়ার আয়োজন করলো কেন? কেনইবা রেজিম চেঞ্জের নামে মৌলবাদীদের সাথে সাম্রাজ্যবাদ গাঁটছড়া বাঁধলো? একটু লিবারেল বিএনপি, লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঠিকভাবে খেলতে পারলে হয়তো ভিন্ন কিছু হলেও বা হতে পারতো, বিএনপি সে জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাক্টিভিস্ট ও দল হিসাবে জামায়াতকে বাছাই করেছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের নানান কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে দীক্ষিত করেছে। একই সাথে যেন ধরা না পড়ে, সেজন্য লীগের সাথে সম্পৃক্ত দু-চারজনকেও ট্রেনিং সেশনগুলোতে রেখেছে। ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে এনডিআই ও আইআরআই আয়োজিত গণতন্ত্র ও সুশাসনের ব্যানারে নামানো প্রশিক্ষণগুলোতে নানান মহারথীরা বক্তব্য দিয়েছেন। এঁদের কয়জন এ সরকারের পারিষদেও আছেন। রেজিম চেঞ্জের জন্য যা করা দরকার তার সবই ট্রেনিং ম্যানুয়ালে ছিল, তাই করা হয়েছে।
লীগ সরকারের জোর করে ক্ষমতায় থাকা, কালো আইনের উপর ভরসা করা, সরকারটির উপর ভারতের ছায়া রয়েছে, এই প্রচার জোরদার করা, ভারত সব দখল করছে, এই অপপ্রচার জোরদার করা, অর্থনীতি গিলে খাচ্ছে ভারত—এসব প্রচার জোরসে করা, সীমান্তে হত্যা—সবই করা হয়েছে। ধর্মীয় ভাবাবেগে ফিলিস্তিনীদের কেফিয়া গলায় জড়ানো হয়েছে, পতাকা তো ছিলই।
এখন কথা উঠছে—সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা পুঁজির পক্ষে থাকলেও, কী কারণে লীগ সরকারকে সরতে হলো? এর উত্তর হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। লীগ সরকার জোর করে ক্ষমতায় থাকলেও সাম্রাজ্যবাদ যা চেয়েছে, করিডোর মতান্তরে মার্কিনীদের ঘাঁটি দেওয়া, তা দেয়নি। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা সরাসরি না করে দিয়েছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদের চোখ রাঙানির বাইরে পদ্মা সেতু তৈরি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি—যা সাম্রাজ্যবাদ ভালো চোখে দেখেনি। এসব নিয়ে বাছাল (বামে দীক্ষিত কিন্তু ছাগাদর্শে বিশ্বাসী) সম্প্রদায়ের অপপ্রচারও ছিল। দিনের পর দিন ভারতবিরোধী বয়ান তৈরি করা হয়েছে। ভারত দুশমন, দেশের হিন্দু সম্প্রদায় আমলাতন্ত্র দখল করে ফেলেছে, অর্থনীতি ভারতের কব্জায়, সীমান্তে হত্যা—এই প্রচার প্রপাগান্ডার পুরোটাই ছিল সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট। লীগের তরফ থেকে যুঁৎসই ব্যাখ্যা দেওয়ার তাড়নাও ছিল না।
ক্ষমতার চেয়ারে এক বছর বসে থাকার পরও আসিফ নজরুল দেশে কাজ করা ২৬ লাখ ভারতীয় খুঁজে পান না! গত এক বছরে ভারতের সাথে করা চুক্তিগুলো বাতিল বা নতুন করে মূল্যায়িত করা হয়নি। আওয়ামী লীগ লুটেরা পুঁজির সহায়তা যেমন করেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে তার মধ্যে কিছুটা জাতীয়তাবাদী বোধও ছিল। যার ফলে সাম্রাজ্যবাদের নখ বিস্তারে আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী বোধ কাজ করেছে। সাম্রাজ্যবাদকে মুখের উপরে না করে দিয়েছে। কিন্তু যে রাজনৈতিক লড়াই ও দৃঢ়তা দেখানোর কথা ছিল, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সে রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছিল না। তার কারণ—দুর্নীতি ও সুশাসনজনিত ঘাটতি। এর ফলে জনগণের কাছে যাওয়ার তাড়নাও ছিল না লীগ সরকারের।
বাছাল (বামে দীক্ষিত কিন্তু ছাগাদর্শে বিশ্বাসী) সম্প্রদায়, শেখ হাসিনা সরকার পতনের বাইনারি তৈরি করে এমন ভাব নিচ্ছে, যেন মহান দেশপ্রেমিকের কাজ করেছে! তা দেশপ্রেমিকদের রাজনৈতিক ফলাফল হচ্ছে—দেশ মৌলবাদের কব্জায় ও সাম্রাজ্যবাদের কোলে খাবি খাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের চেলা ও এ সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য পর্যন্ত মার্কিনীদের সাথে এ সরকারের নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) সই করা নিয়ে গোস্বা করেছেন! তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সহযোগী দেশ এনডিএ ডকুমেন্ট দেয়নি।
দেশ এখন গভীর সংকটে। সাম্রাজ্যবাদ মৌলবাদীদের সহায়তা করছে, করিডোর চাচ্ছে, ভূরাজনৈতিক যুদ্ধে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ফেলছে, দেশকে বিভক্ত করছে। রেজিম চেঞ্জে ডলার ঢেলেছে বলে প্রকাশ্যেই বলেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এখন তার প্রতিদান চাচ্ছে। রেজিম চেঞ্জে অংশ নেওয়া নানান অংশীজনরা, নানান বয়ান হাজির করেছে। কে কিভাবে আগুন দিয়েছে? কে ৭.৬২ দিয়ে গুলি করেছে? কার আগুনে পুড়েছে মেট্রোরেল? কারা আগুন দিয়েছে বিটিভিতে? সবই নিজ নিজ বয়ান হাজির করে ফেলেছে।
রাজনীতি-বিহীন নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে রেজিম চেঞ্জের ফলে যা হবার কথা তাই হচ্ছে। দেশ নৈরাজ্যে ডুবে যাচ্ছে। পরিকল্পিত উপায়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতা ছড়ানো হচ্ছে। গণমাধ্যমকে কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এমন বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে পড়েনি গণমাধ্যম। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী!নৈরাজ্যকে মহিমান্বিত করার মতো আস্ফালন করবে কেবলমাত্র মিথ্যাবাদীরা—যারা কেবল ভাবাবেগের উপর ভর করে চলে।
চিন্তাশক্তি ও নির্মোহ দৃষ্টি থাকলেই কেবল সাম্রাজ্যবাদের খপ্পর থেকে বেরোবার চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি বের করা যায়। উনমানুষরা ভাবাবেগের কাছে পরাস্ত হয়। যে সমস্ত রাজনৈতিক কর্মীরা রাজনীতির ভবিষ্যৎ দেখতে অপারগ, তারা সহজেই সাম্রাজ্যবাদের ফাঁদে পড়ে ইঁদুরনৃত্য করে। তারা বুঝতে ও চিনতে অপারগ সাম্রাজ্যবাদের চর মার্কিন অ্যাক্টিভিস্ট ও দালালদের মুখোশের আড়ালের চেহারা!যে দালালরা তাদের দেশে মই দিয়ে ফেলছে, তাদের ভবিষ্যৎ খেয়ে ফেলছে সংস্কারের নামে, সেই সমস্ত দালালদের পিছনেই তালি বাজানোর নাম বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান না। সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছায় নৃত্য করার নাম হচ্ছে রেজিম চেঞ্জ। দেশকে ভূরাজনৈতিক ফাঁদে ফেলে দেওয়া, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা, রাজনৈতিক সহনশীলতা ধ্বংস করা, সামাজিক শক্তির বিনাশ ঘটানো, ধর্মীয় মাজার ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ভাঙা, শিক্ষক সম্প্রদায় ও বুদ্ধিজীবীদের উপর নৈরাজ্য চালানো—এর কোনটাই গণ-অভ্যুত্থানের চরিত্র নয়।
যারা গণ-অভ্যুত্থান বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে, তারা সব রেজিম চেঞ্জের ফলে সাম্রাজ্যবাদের নয়া শরিক নতুন সরকারের বন্দোবস্তের অংশীজন। হালুয়া ঘাটের সদস্য। সাম্রাজ্যবাদের চর ও অংশীজনরা বিপ্লবী—এটি পাগলের প্রলাপ! রাজনীতির উনমানুষরাই প্রলাপ ডাকে বেশি।
লেখক: আকরামুল হক, সাবেক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন