একসময় গণতন্ত্রকে বলা হতো ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও উন্নত শাসনব্যবস্থা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিরোধিতার অধিকার, আইন ও ন্যায়ের শাসন এসবই গণতন্ত্রের স্তম্ভ। কিন্তু আজ এই কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে নীরবে। ভোট থাকলেও ভোটার নির্বিকার; গণপরিষদ আছে, কিন্তু গণতা নেই; নেতৃত্ব আছে, কিন্তু নীতির শূন্যতা প্রকট। তার বদলে উঠে এসেছে মবতন্ত্র যেখানে জনতার নামে চলছে উগ্রতা, বিভ্রান্তি ও ভীতির রাজনীতি।
গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত হলো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ও স্বাধীন নাগরিক। কিন্তু যখন নাগরিকরা শুধু উসকানির শিকার হয়ে আবেগে বিপথে যায়, কিংবা ভয়, বিভ্রান্তি ও পক্ষপাতদুষ্টতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেই গণতন্ত্র রূপ নেয় মবতন্ত্রে।
মবতন্ত্রের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এতে যুক্তির কোনো স্থান নেই। এখানে বিশ্লেষণ নয়, থাকে আবেগ। আলোচনা করার পরিবর্তে দেয়া হয় হুমকি-ধমকি। এই ব্যবস্থায় সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে ওঠে প্রধান অস্ত্র, যেখানে সত্য-মিথ্যার কোনো বাছবিচার না করেই গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। যারা বেশি চেঁচায়, তাদের কথাই যেন সত্য ধরে নেয়া হয়। এমনকি সরকার কিংবা রাজনৈতিক নেতারাও এই মবকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং তোষণ করে চলেছেন। তারা জানেন, সংগঠিত জনতার চাপে প্রশাসনকে নতজানু করা যায়, আদালতের রায় প্রভাবিত করা যায়, এমনকি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তও বদলানো যায়। ফলে জনপ্রিয়তার নামে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার এক নতুন কৌশল চালু হয়েছে।
মবতন্ত্র মানে শুধু জনতার শাসন নয়, বরং একটি উগ্র ও প্ররোচিত জনতার চাপে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ। এটা গণতন্ত্রের ছায়ায় গড়ে ওঠা এমন এক ব্যবস্থাপনা, যেখানে সংখ্যার জোরই সত্য এবং যুক্তির জায়গায় স্থান পায় স্লোগান, ভীতি ও গুজব। মবতন্ত্র এমন এক বাস্তবতা, যেখানে সংখ্যাই সত্য, অথচ সেই সংখ্যা প্রভাবিত হয় ভয়, ভুল তথ্য অথবা একচোখা আনুগত্যে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সময়ে মবতন্ত্রের প্রকট আকার ধারণ করেছে। একদিকে সরকার পক্ষের রাজনীতি যেভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখিয়ে সব সিদ্ধান্তকে বৈধতা দিচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী মতও ‘জনতার রোষ’, ‘জনতার আদালত’ এর নামে আইনের শাসনের বাইরে অবস্থান নিতে চায়। আদালতের রায় মানা না মানা এখন দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে, গুজব রটিয়ে ফেইসবুকেই বিচার সম্পন্ন হয়ে যায়, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যুক্তিবোধ নয়, হুজুগই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এসব মিলে স্পষ্ট হয়, গণতান্ত্রিক কাঠামো থেকে আমরা ধীরে ধীরে একধরনের পপুলিস্ট ও মব-চালিত সংস্কৃতির দিকে যাচ্ছি, যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব ক্ষমতার কেন্দ্রে নয়, বরং মিথ্যা তথ্য, প্রচারণা ও উগ্র আবেগের হাতে বন্দী।
এই ব্যাধি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী এক ধরনের গণতন্ত্রের সংকট দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ছিল মবতন্ত্রের অন্যতম উদাহরণ যেখানে রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠেছিল বিদ্বেষ, বিভক্তি ও মিথ্যাচার। ২০২১ সালের ক্যাপিটল হিলে হামলা ছিল তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। ভারতে মবতান্ত্রিক মেজরিটারিয়ান রাজনীতির মাধ্যমে নাগরিকদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভাগ করা হচ্ছে। ভোটের সংখ্যাতেই সবকিছু বৈধতা পাচ্ছে, নীতিনৈতিকতা নয়। ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন, রাশিয়া-ইউক্রেন, সুদান ও নাইজেরিয়া ও বর্তমান বাংলাদেশেও মবের নামে জনমত ব্যবহৃত হচ্ছে হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে।
গণতন্ত্র যেখানে চর্চা ও সহনশীলতার জায়গা, সেখানে ২০২৫ সালের বাংলাদেশে রাজনীতি হয়ে উঠেছে ব্যক্তির আনুগত্যের প্রতিযোগিতা, চিৎকারের কৌশল, গণজোয়ারের নামে নাটকীয় মঞ্চায়ন। সংসদ নেই, বিরোধী দল কার্যত নেই, মিডিয়া ভয় পায়। ফলে রাষ্ট্র চালিত হয় সরকারি সিদ্ধান্ত ও জনতার মুখে স্লোগানের সমর্থন এই যুগল সূত্রে।
বর্তমান সময়ে মবতন্ত্রকে বেগবান করেছে সোশ্যাল মিডিয়া। সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে যেকোনো পোস্ট ভাইরাল হয়, মানুষ উত্তেজিত হয় এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেটিকে ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে আবেগ তৈরি করে। এআই দিয়ে বানানো ডিপফেইক ভিডিও, মিথ্যা তথ্যভিত্তিক প্রচারণা, এবং স্যাংশনকৃত মিডিয়া পরিবেশ সব মিলিয়ে আজ একজন নাগরিকের সত্য জানার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
গণতন্ত্র বলে সংখ্যা নয়, যুক্তি ও আইনের শাসন বড়। কিন্তু মবতন্ত্র বলে সংখ্যা বড়, তা যত হিংস্রই হোক। এই ব্যবস্থায় বিরোধী দল হয়ে ওঠে রাষ্ট্রবিরোধী, ভিন্নমত মানেই বিশ্বাসঘাতকতা, আর নিরপেক্ষতা মানে সুবিধাবাদিতা। ফলে সমাজ দ্বিখ-িত হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক আলোচনার জায়গা দখল করে কাদা ছোড়াছুড়ি। গণতন্ত্র একদিনে ধ্বংস হয় না। সেটি ভোটের নামে বিভ্রান্তি, নেতৃত্বের নামে উগ্রতা, আর জনতার নামে হিংসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে মরতে থাকে। এখন প্রশ্ন আমরা কি এই মবতন্ত্রের শাসনে অভ্যস্ত হয়ে যাব? না কি আবার যুক্তি, দায়িত্ব আর ন্যায়ের পথে ফিরে যাব?
গণতন্ত্রের বিকল্প গণতন্ত্রই এই সত্য আমরা ভুলে যাচ্ছি। প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে দরকার মানুষকে মানুষ করে তোলা, চিন্তাশীল নাগরিক করে গড়া। শিক্ষা, সচেতনতা, স্বাধীন মিডিয়া ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এই চারটি স্তম্ভ যদি ভেঙে পড়ে, তবে গণতন্ত্র থাকবে শুধুই একটি শব্দ আর ভোট থাকবে নিছক আনুষ্ঠানিকতা। এই উপাদানগুলো আবার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নচেৎ আমরা শুধু “ভোট দিচ্ছি” বলেই গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রেখেছি ভেবে আত্মতুষ্টি পাব, কিন্তু আসলে বেঁচে থাকব এক উগ্র, হিংস্র ও অন্ধ জনতার শাসনের মধ্যে। তাই রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি নাগরিকদেরও ভাবতে হবে আমরা কি প্রকৃত নেতৃত্ব চাই, নাকি শোরগোলের পেছনে ছুটতে ছুটতে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকাব?
গণতন্ত্রের নামে যদি মবতন্ত্র চালু থাকে, তবে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ন্যায়ের কোনো জায়গা থাকবে না। তখন আইন হবে সংখ্যাগরিষ্ঠের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল, এবং সংবিধান হবে এক টুকরো কাগজমাত্র। আজ প্রয়োজন চিন্তার বিপ্লব, আলোচনার সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি সম্মান। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদেরকে ক্ষমা করবে না।
গণতন্ত্র যখন ব্যর্থ হয়, তখন একনায়কতন্ত্র আসে ভিন্ন নামে। কিন্তু তার চেয়েও বিপজ্জনক যখন মবতন্ত্র আসে ‘জনগণের ইচ্ছা’ বলে। এই ভুয়া জনগণের শাসনে রাষ্ট্রপরিচালনা চলে উসকানি, বিভ্রান্তি ও ভয়ের ভিত্তিতে। এখনো সময় আছে আমরা চাইলে চিন্তাশীল, দায়িত্ববান ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আবারও সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারি। কিন্তু তার আগে জানতে হবে, আমরা আজ কোথায় দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রে, না মবতন্ত্রে?
লেখক : সভাপতি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম প্রকাশ: সংবাদ, ১৭ জুলাই ২০২৫
মন্তব্য করুন