১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত। এই দিনে ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা, বিশেষত ক্র্যাক প্লাটুন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে অভূতপূর্ণ গেরিলা অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানগুলো ছিল উলুন পাওয়ার স্টেশন, খিলগাঁও পাওয়ার সাবস্টেশন এবং গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনে। এছাড়াও এই দিনে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হুমকি, এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য বিশ্বব্যাপী সমর্থনের উদ্যোগের মতো ঘটনাবলি ঘটে। নিম্নে এই দিনের ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান: ঢাকার বিদ্যুৎকেন্দ্রে আঘাত
১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই রাতে মুক্তিবাহিনীর ক্র্যাক প্লাটুন ঢাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রে একযোগে অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকার অবকাঠামোর ওপর আঘাত হানা এবং তাদের শক্তি দুর্বল করা। নিম্নে তিনটি অভিযানের বিবরণ দেওয়া হলো:
উলুন পাওয়ার স্টেশন অভিযান
রাত ৯টার দিকে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধারা রামপুরা–সংলগ্ন উলুনে অবস্থিত ঢাকার সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে অংশ নেন গাজী গোলাম দস্তগীর (বীর প্রতীক), মতিন এক, মতিন দুই, নীলু, জিন্নাহ এবং হাফিজ। দুঃখজনকভাবে, গাজী গোলাম দস্তগীর ব্যতীত এই অভিযানে অংশ নেওয়া অন্যান্য যোদ্ধারা পরবর্তীতে শহীদ হন।
গেরিলা দলটি ২০ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, ডেটোনেটর এবং ফিউজ নিয়ে এই অভিযানে অংশ নেয়। তারা অত্যন্ত সুচারুভাবে পুলিশ ও গার্ডদের ফাঁকি দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রবেশ করে। একজন কমান্ডো টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। এরপর তারা ১৭ জন পুলিশকে বন্দী করে এবং অপারেটরকে বাধ্য করেন তাদের ট্রান্সফরমার রুমে নিয়ে যেতে। গেরিলারা ট্রান্সফরমার রুমে বিস্ফোরক স্থাপন করে এবং সফলভাবে তা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উলুন পাওয়ার স্টেশনের ট্রান্সফরমার ধ্বংস করে। এই অভিযান ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে।
খিলগাঁও এবং গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন অভিযান
একই সময়ে, ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য দুটি দল খিলগাঁও পাওয়ার সাবস্টেশন এবং গুলবাগ পাওয়ার স্টেশনে অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানগুলোতে অংশ নেন পুলু, সাইদ, জুয়েল (পরে শহীদ ও বীর বিক্রম), হানিফ, মূখতার, মোমিন, মালিক এবং বাসার। খিলগাঁও অভিযানে তাদের সহযোগিতা করেন নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, যিনি পরবর্তীতে শহীদ হন। উভয় অভিযানেই গেরিলারা বিস্ফোরক ব্যবহার করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অভিযানগুলো পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকার অবকাঠামোর ওপর আরেকটি শক্তিশালী আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই তিনটি অভিযান মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধকৌশলের দক্ষতা এবং দুঃসাহসিকতার প্রমাণ বহন করে। এই অভিযানগুলো পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মনোবল ভাঙতে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের ঘোষণা
একই দিনে মুজিবনগরে অবস্থিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেওয়া হয়। একজন মুখপাত্র জানান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের নাম পরিবর্তন করে এখন থেকে ‘মুক্তিবাহিনী’ বলা হবে। এই নামকরণ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠিত রূপ এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও, মুক্তিবাহিনীর বিমান ও নৌবাহিনী গঠনের প্রচেষ্টা চলছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধকে আরও শক্তিশালী এবং বহুমুখী করার লক্ষ্যে গৃহীত হয়।
একই সঙ্গে, মুজিবনগরে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির তত্ত্বাবধানে একটি চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচের ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ফুটবল একাদশ ২৫ জুলাই কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদীয়া জেলা দলের সঙ্গে এই ম্যাচে অংশ নেবে। এই খেলা থেকে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম তহবিলে দেওয়া হবে, যা মুক্তিযুদ্ধের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানে ব্যবহৃত হবে।
বঙ্গবন্ধুর বিচার ও ইয়াহিয়ার হুমকি
এই দিনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হয়। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে উদ্ধৃত করে বিবিসি জানায়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শিগগিরই গোপনে সামরিক আদালতে অনুষ্ঠিত ওঠবে। শেখ মুজিবকে উকিলের সাহায্য দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে, তবে বিদেশি কোনো উকিল এই মামলায় অংশ নিতে পারবেন না। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এই মামলার রায় পর্যালোচনার একমাত্র ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হাতে থাকবে।
ইয়াহিয়া খান আরও হুমকি দিয়ে বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশের কোনো অংশ অধিকার করার চেষ্টা করে, তবে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। তিনি এই ধরনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করবেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের উদ্ধৃতি অনুসারে, ইয়াহিয়া খান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে দেখা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে ইন্দিরা গান্ধী এই প্রস্তাবে সম্মত হননি।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন
১৯ জুলাই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি সমর্থনের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। বিটলসের সদস্য জর্জ হ্যারিসনের ম্যানেজারের একজন মুখপাত্র নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে জর্জ হ্যারিসন ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি গান রেকর্ড করেছেন। এই গানে বাংলাদেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা রয়েছে। গানটি ২৩ জুলাই বিভিন্ন রেডিও স্টেশনে প্রচারিত হবে এবং ২৬ জুলাই থেকে বাজারে বিক্রি শুরু হবে। একই দিনে সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্করেরও একটি রেকর্ড প্রকাশিত হবে। এই রেকর্ড বিক্রির সমস্ত অর্থ জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্করের বিশেষ ত্রাণ তহবিলে জমা হবে, যা ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের, বিশেষত শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হবে। এছাড়াও, ১ আগস্ট শরণার্থী শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হচ্ছে।
একই দিনে ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং রাজ্যসভায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানকে অব্যাহত অস্ত্র সরবরাহ ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তিনি আরও বলেন, এই অস্ত্র সরবরাহ বাংলাদেশে গণহত্যাকে সমর্থন করার সমতুল্য। রাজ্যসভার সদস্যরাও যুক্তরাষ্ট্রের এই অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন।
১৯ জুলাই ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযানগুলো পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করতে এবং জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুজিবনগরের ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠিত রূপ এবং জাতীয় ঐক্যকে আরও শক্তিশালী করে। একই সঙ্গে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার নিয়ে ইয়াহিয়ার হুমকি এবং বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্করের মতো আন্তর্জাতিক শিল্পীদের উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করে। এই দিনের ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের বহুমুখী প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সংহতির একটি প্রতিচ্ছবি।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই
ইত্তেফাক, ২০ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২০ ও ২১ জুলাই ১৯৭১
মন্তব্য করুন