১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার জন্য একটি ঐতিহাসিক সংগ্রাম, যা দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে চিহ্নিত হয়েছিল। ২১ জুলাই ১৯৭১ তারিখে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যা কূটনৈতিক উদ্যোগ, সামরিক অভিযান এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটায়। নিম্নে এই দিনের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হলো, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য চলমান প্রচেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিকে তুলে ধরে।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য কূটনৈতিক আবেদন
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের তারবার্তা
২১ জুলাই ১৯৭১ তারিখে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতার কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। এই তারবার্তায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের মুক্তির জন্য জরুরি হস্তক্ষেপের আবেদন জানান। এই বার্তা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটেন, ভারত, কানাডা, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীদের উদ্দেশে পাঠানো হয়। এই আবেদন আন্তর্জাতিক কূটনীতির মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে বন্দী বাংলাদেশের নেতার মুক্তির জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিশ্বের যুব ও ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান
মুক্তাঞ্চল থেকে পরিচালিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে বিশ্বের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে আবেদন জানায়। তারা ইয়াহিয়া খানের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা কামনা করে। এই আহ্বান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠন এবং ন্যায়বিচারের দাবিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তৃণমূল আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধরে।
অর্থনৈতিক কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সহায়তা
অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, কারণ তারা পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এখন দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। তিনি জোর দিয়ে বলেন, শুধুমাত্র সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য প্রবেশ করতে পারে। এই অবস্থান বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের বৈধতা এবং পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী করে।
জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভারতের অস্বীকৃতি এবং মুক্তিবাহিনীর প্রতি সমর্থন
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
নয়াদিল্লিতে এই দিন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ সীমান্তের দুই পাশে জাতিসংঘের উদ্যোগে পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে। মুখপাত্র জানান, ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে এবং বাংলাদেশে তথাকথিত পাকিস্তানি অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলোতে পর্যবেক্ষক মোতায়েন করলে চলমান গণহত্যা বন্ধ হবে না। বরং এটি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বে একটি মিথ্যা আত্মতৃপ্তির মনোভাব তৈরি করবে। এই দৃঢ় প্রত্যাখ্যান সংকটের মূল কারণ সমাধানে ভারতের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।
মুক্তিবাহিনীর প্রতি ভারতের প্রকাশ্য সমর্থন
ভারতীয় মুখপাত্র আরও বলেন, ভারত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে সব ধরনের সাহায্য প্রদান করবে, প্রয়োজনে অস্ত্রও সরবরাহ করবে। ভারত কখনোই মুক্তিবাহিনীর প্রতি তার সমর্থন গোপন করেনি এবং এখনো গোপন করার কোনো কারণ দেখে না। এই অবস্থান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা এবং মুক্তিবাহিনীর প্রতি তার দৃঢ় সমর্থনের প্রমাণ বহন করে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন ও প্রতিক্রিয়া
অস্ট্রেলিয়ার এমপি ম্যানফেড ক্রসের বক্তব্য
ভারত সফররত অস্ট্রেলিয়ার লেবার পার্টির এমপি ম্যানফেড ক্রস কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, সব দেশের উচিত পাকিস্তানের প্রতি সকল প্রকার অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করা। এছাড়া, বাংলাদেশের দুস্থ মানুষদের জন্য সব ধরনের সাহায্য আন্তর্জাতিক তদারকিতে পাঠানো উচিত। এই বক্তব্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্রমবর্ধমান ঢেউকে প্রতিফলিত করে।
ইসরায়েলের আবেদন
ইসরায়েল এই দিন বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কাছে আবেদন জানায়, বাংলাদেশের অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এই আহ্বান বাংলাদেশে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের প্রকাশ ঘটায়।
পাকিস্তানে ঘটনাপ্রবাহ
ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিবের সফর
ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান চার দিনের সফরে করাচি থেকে ঢাকায় পৌঁছান। পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী এবং সাহায্য ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী আবদুল মোত্তালিব মালিক তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। টুংকু আবদুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন জর্দানের রাষ্ট্রদূত কামাল আল শরিফ, পাকিস্তানে কুয়েত দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সোলায়মান আবু গাউস, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রেজা তাকাভি এবং মহাসচিবের বিশেষ সহকারী আলী বিন আবদুল্লাহ।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর বক্তব্য
পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ২৮ জুন প্রচারিত প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়: একটি অংশে রয়েছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা, এবং অন্য অংশে প্রেসিডেন্টের নিজস্ব মতামত। ভুট্টো জানান, পরিকল্পনার কিছু বিষয়ে তাঁদের ভিন্নমত রয়েছে, আবার কিছু বিষয়ে তারা একমত। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর আলোচনা চলছে।
মুক্তিবাহিনীর সামরিক অভিযান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অতর্কিত আক্রমণ
মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শালদা নদী অবস্থানে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যান।
চাঁদপুরে অ্যামবুশ
একদল মুক্তিযোদ্ধা চাঁদপুর থেকে আশিকাটির দিকে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় টহল দলের ওপর অ্যামবুশ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর তিনটি গাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং কয়েকজন সেনা হতাহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড গুলির মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন।
ঠাকুরগাঁওয়ে গেরিলা অভিযান
আরেক দল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ঠাকুরগাঁওয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দলকে অ্যামবুশ করে, যাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এই অভিযান মুক্তিবাহিনীর কৌশলগত দক্ষতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষমতা প্রদর্শন করে।
২১ জুলাই ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক—কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক—একযোগে সক্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন, পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভারতের দৃঢ় সমর্থন এবং মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান এই দিনের ঘটনাপ্রবাহকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। এই সমস্ত প্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও জোরালো করেছিল এবং বিশ্বব্যাপী এর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিল।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই ও সাত
ইত্তেফাক, ২২ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২২ ও ২৩ জুলাই ১৯৭১
মন্তব্য করুন