১৯৭১ সালের ২২ জুলাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে দেশ-বিদেশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করেছিল। এই প্রতিবেদনে তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি, মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন, এবং পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের প্রচারণার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি: বঙ্গবন্ধুর বিচার বন্ধের আহ্বান
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই দিন মুজিবনগর থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দেন। তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে বিচারের হুমকির তীব্র নিন্দা করেন। তাজউদ্দীন বলেন, এই বিচার কেবল একটি প্রহসন হবে এবং এটি কোনোভাবেই ন্যায়বিচারের প্রতিনিধিত্ব করবে না। তিনি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান, তাদের নিজ নিজ সরকার এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে এই প্রহসনমূলক বিচার বন্ধ করতে এবং ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য করতে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন কেবল বাংলাদেশের জনগণের জন্যই নয়, বরং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য।
তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সমস্ত পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো দেশের মুক্তি এবং জনগণের কল্যাণ। এই সমাবেশে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ
এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা টাঙ্গাইলের বাশাইল থানার কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের উপর আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাছ থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করতে সক্ষম হন। এই ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও সংগঠিত প্রতিরোধের সক্ষমতার প্রমাণ বহন করে। এটি পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবলের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং মুক্তিযুদ্ধের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন
নিউইয়র্কে কনসার্ট
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এই দিন ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে একটি কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। এই কনসার্টে বিশ্ববিখ্যাত সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং বিটলসের সদস্য জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টার অংশগ্রহণ করেন। এই কনসার্টের প্রতি জনগণের আগ্রহ ছিল অভূতপূর্ব—১০ ঘণ্টার মধ্যে ৩৬ হাজারের বেশি টিকিট বিক্রি হয়। উপচে পড়া ভিড়ের কারণে উদ্যোক্তারা ঘোষণা দেন যে, ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আরও বৃহত্তর আকারে এই কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে। এই কনসার্ট বাংলাদেশের শরণার্থী সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাতিসংঘে উদ্বেগ ও আলোচনা
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট এই দিন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠান। এই বার্তায় তিনি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্ভাব্য সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই দিনে, জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত সমর সেন উ থান্টের সঙ্গে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। এই আলোচনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং শরণার্থী সংকট সমাধানের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাব
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল জানায়, পাকিস্তান জাতিসংঘের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, যাতে বাংলাদেশি শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের সুবিধার্থে ভারত ও পাকিস্তানে জাতিসংঘের বেসামরিক প্রতিনিধি মোতায়েনের কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাব বাংলাদেশের শরণার্থী সংকট সমাধানে একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হলেও, এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় ছিল।
পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের প্রচারণা ও বিক্ষোভ
কানাডার রাজধানী অটোয়ায় পাকিস্তানি প্রতিনিধি হামিদুল হক চৌধুরী এবং মাহমুদ আলী একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। হামিদুল হক চৌধুরী, যিনি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন, এবং মাহমুদ আলী, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সহসভাপতি, দাবি করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে কোনো গণহত্যা হয়নি। তারা আরও বলেন, সুসংঘবদ্ধ কিছু দল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। তবে, তাদের এই বক্তব্যের সময় বাঙালি সম্প্রদায় তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, যা পাকিস্তানি প্রচারণার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার ইঙ্গিত দেয়।
ভারতের সমর্থন ও পরিকল্পনা
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে বলেন, বাংলাদেশের সমস্যা কোনো দলীয় বা ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং এটি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত একটি জাতির লড়াই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যে কোনো দেশ যদি নিজেদের বাস্তবতা সম্পর্কে সজাগ থাকে, তবে তার সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মতো এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পৃথিবীর খুব কম দেশই হয়েছে।
দিল্লিতে সরকারিভাবে জানানো হয়, ইন্দিরা গান্ধী ২৬ জুলাই বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। এই বৈঠকে ইয়াহিয়া খানের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার হুমকি নিয়েও আলোচনা হবে। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাংলাদেশ তথ্যানুসন্ধান কমিটির সম্পাদক শৈবালকুমার গুপ্ত জানান, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে একটি অরাজনৈতিক তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির উপর নিরপেক্ষ প্রতিবেদন তৈরি করবে।
পাকিস্তান ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পরিস্থিতি
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সফররত ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান ঢাকায় সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং জাতিসংঘের সাহায্য ও শরণার্থীবিষয়ক প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সঙ্গে জর্ডান, ইরান, কুয়েত ও আফগানিস্তানের প্রতিনিধিরা ছিলেন। তিনি ঢাকা শহরের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ কিছু এলাকা পরিদর্শন করেন।
একই দিনে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি আদেশ জারি করে রাজাকারদের যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা প্রদান করে। এই আদেশ পাকিস্তানি বাহিনীর দমননীতির অংশ হিসেবে দেখা হয়। এছাড়া, জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মিয়া মোহাম্মদ তোফায়েল করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সদস্যদের আসন বাতিল করে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থান অধিকারীদের নির্বাচিত ঘোষণার দাবি জানান।
২২ জুলাই ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বহুমাত্রিক দিন হিসেবে চিহ্নিত। তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের দৃঢ়তা প্রকাশ করে। একই সঙ্গে, নিউইয়র্কে কনসার্ট, জাতিসংঘে আলোচনা এবং ভারতের সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের মিথ্যা প্রচারণা এবং রাজাকারদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা তাদের দমননীতির ধারাবাহিকতা প্রকাশ করে। এই সকল ঘটনা মিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দিনের চিত্র তুলে ধরে।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এগারো
ইত্তেফাক, ২৩ জুলাই ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২৩ ও ২৪ জুলাই ১৯৭১
মন্তব্য করুন