ঢাকা রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

কোপার্নিকাস: আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

​​​​​​​সৈয়দ আমিরুজ্জামান
প্রকাশ : ১৯ জুলাই ২০২৫, ০৩:৩৯ পিএম
নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩ - ১৫৪৩), গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ, মহাবিশ্বের একটি মডেল প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে পৃথিবীর পরিবর্তে সূর্যকে কেন্দ্রে রাখা হয়। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই, অন দ্য রেভোলিউশনস অফ হেভেনলি বডিজ, ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তা অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল, তবে তা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি মৌলিক টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে।
নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩ - ১৫৪৩), গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ, মহাবিশ্বের একটি মডেল প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে পৃথিবীর পরিবর্তে সূর্যকে কেন্দ্রে রাখা হয়। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই, অন দ্য রেভোলিউশনস অফ হেভেনলি বডিজ, ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তা অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল, তবে তা বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি মৌলিক টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে।

নিকোলাস কোপার্নিকাস অন্ধকার ও অজ্ঞতার যুগে আলো হয়ে জন্ম নেওয়া এক মহান বিজ্ঞানী। যিনি পর্যবেক্ষণ করে গেছেন আকাশের গ্রহ, তারার গতিবিধি। লিখে গেছেন, সেই সময়কালে প্রচলিত ভুল ধারণার বিরুদ্ধে; কিন্তু সেই সময়কালের তথাকথিত জ্ঞানীদের বিরুদ্ধে যায় এমন কথা বলা সহজ ছিল না তখন। সে সময় পৃথিবী ও সূর্য সম্বন্ধে ধারণা আজকের মতো ছিল না। সকলে মনে করত পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ আবর্তিত হয়। কিন্তু কোপার্নিকাস তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেছেন, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ আবর্তিত হয়। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, ‘পৃথিবী নয়, সূর্যই হলো সৌরজগতের কেন্দ্র। সূর্যই পুরো সৌরজগতকে আলোকিত করে।’

কোপার্নিকাস বুধের তিনটি পর্যবেক্ষণ করেন যার মধ্যে ত্রুটি ছিল ৩, -১৫, ১ মিনিট চাপ। তিনি ভেনাসের পর্যবেক্ষণ করেন যার ত্রুটি ছিল -২৪ মিনিট চাপ। মঙ্গলের চারটি পর্যবেক্ষণ করেন যার ত্রুটির মান ছিল ২, ২০, ৭৭, ১৩৭ মিনিট চাপ। জুপিটার পর্যবেক্ষণে ৪টি ত্রুটি পাওয়া যায় সেগুলো হলো ৩২, ৫১, -১১ এবং ২৫ মিনিট চাপ। শনির সাথেও ৪টি পর্যবেক্ষণ ত্রুটি ছিল ৩১, ২০, ২৩ এবং -৪ মিনিট চাপ।

উচ্চতর শিক্ষা শেষে তিনি রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। সে সময় তার মনে মহাবিশ্ব সম্বন্ধে টলেমির সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে সন্দেহ জাগে। পৃথিবী এই মহাবিশ্বের মাঝে অবস্থিত, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য, তারা আর চাঁদ ঘুরছে—এই নিয়মে তিনি কিছু ত্রুটি খুঁজে পান। ক্লাসে যখন ছাত্রদের টলেমির সিদ্ধান্ত পড়াতেন, তখন তার বারবার মনে হতো তিনি ভুল শিক্ষা দিচ্ছেন।

প্রকৃত সত্যকে জানবার জন্য এ বিষয়ে আরও গভীর অধ্যয়ন শুরু করলেন। পরস্পর বিরোধী এসব অভিমতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মনে হলো প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটন করতে হবে। যে বিষয়ে নিজেই সন্দিহান, কেমন করে তা ছাত্রদের পড়াবেন? এরই মাঝে এক ছাত্র তাকে প্রশ্ন করে বসলো, “স্যার, আপনি যা বলছেন তা কি বিশ্বাস করেন?” দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন কোপার্নিকাস। মানসিক পীড়ায় শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিলেন। এখান থেকে শুরু হলো তার মনে উদ্রেক হওয়া জিজ্ঞাসার উত্তর খোঁজার পালা।

সে সময় টেলিস্কোপ ছিল না, তাই সাধারণ পর্যবেক্ষণ আর গাণিতিক পদ্ধতির উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না। ফ্রাউয়েনবার্গ গির্জায় থাকাকালে একাকী তিনি চালিয়ে যান গবেষণা ও অনুসন্ধানের কাজ। এ ক্ষেত্রে কারও কাছ থেকে সহযোগিতা বা পরামর্শ তিনি পাননি। গির্জাটি ছিল একটি পাহাড়ের উপর। এর কাছাকাছি একটি গম্বুজ থেকেই নিকোলাস তার পর্যবেক্ষণ চালাতেন। গির্জার দেয়ালে একটি উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহরাজির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। খালি চোখেই নিজের পর্যবেক্ষণের ফলাফল লিপিবদ্ধ করে রাখতেন এবং সময়ে সময়ে সেগুলো প্রকাশ করতেন। তার ব্যক্তিগত পাঠাগারের বইয়ের পৃষ্ঠাতেও এরকম কিছু মন্তব্য লিপিবদ্ধ পাওয়া গেছে।

তখন প্রচলিত ছিল টলেমির পদ্ধতি। একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি অনুধাবন করতে পারেন টলেমির ব্যাখ্যায় ত্রুটি আছে। বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলে না টলেমির মডেল থেকে। টলেমির ধারণাকে ফেলে হিসেব করে দেখলেন সূর্যকে কেন্দ্রে রাখলে সকল কিছুর হিসাব মিলে যায়। পৃথিবীকে গায়ের জোরে কেন্দ্রে বসালেই অযথা জটিলতা তৈরি হয়।

পরবর্তীতে তার পথ ধরে ধীরে ধীরে আলোকিত করেছেন টাইকো ব্রাহে, কেপলার, ব্রুনো এবং গ্যালিলিও গ্যালিলি। তারা ভুল-ত্রুটি শুধরে নিয়ে সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

কোপার্নিকাস বলেন, ‘সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে বলে ঋতু পরিবর্তন হয়। আর পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপর আবর্তিত হয় বলেই দিন-রাত্রি হয়।’ তিনিই প্রথম বলেন, সূর্যই সমগ্র সৌরজগতকে আলোকিত করে।

কোপার্নিকাস তার আদর্শ, চিন্তাভাবনা, কাজের একটি সারাংশ তৈরি করেন, যা তার বন্ধুরা সহজেই পড়তে ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ১৫১৪ সালে তিনি এই হেলিওসেন্ট্রিকের প্রাথমিক ধারণা দেন। এর মধ্যে ৭টি ধারণা ছিল। তিনি পরবর্তীতে আরও কাজ করেন এবং তথ্য ও ডেটা সংগ্রহ করেন। ১৫৩২ সালে তিনি তার ‘দি রেভোলিউশনিবাস অরবিয়াম কোয়েলেস্টিয়াম’ এর কাজ শেষ করেন। তার কাছের বন্ধুদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি তার বইটি সবার জন্য উন্মুক্ত করতে চান। ১৫৩৩ সালে জন আলবার্ট উইডম্যানস্টাটার রোমে কোপার্নিকাসের তত্ত্বের ধারাবাহিক বক্তব্য দেন। পোপ ক্লেমেন্ট (সপ্তম) এবং ক্যাথলিক কার্ডিনাল এতে খুশি হন এবং এই তত্ত্বের উপর আগ্রহ প্রকাশ করেন।

১৫৩৩ সালের ১ নভেম্বর কার্ডিনাল নিকোলাস রোম থেকে কোপার্নিকাসের নিকট একটি চিঠি প্রদান করেন—

কয়েক বছর আগে আমি আপনার কাজ সম্পর্কে অবগত হয়েছি। সে সময় থেকেই আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি কারণ আমি জেনেছি আপনি অন্যান্য প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের মতো নন। আপনি ভিন্ন কিছু করছেন, নতুন কিছু করছেন। আপনি বলেছেন পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারদিকে যা মহাবিশ্বের কেন্দ্র। আমি আপনার কাছ থেকে এসব শিখেছি জনাব। যদি আপনার অসুবিধা না হয় তাহলে আপনার এই আবিষ্কারগুলো জ্যোতির্বিদদের কাছে পাঠান এবং আপনার লেখাগুলো একত্র করে আমার কাছে পাঠান।

এরপরই ইউরোপের শিক্ষিত লোকের কাছে কোপার্নিকাসের কাজ পৌঁছতে থাকে। কোপার্নিকাস এরপরও তার বইটি প্রকাশ করতে দেরি করেন। তার অন্যতম কারণ ছিল তিনি তৎকালীন সমাজের অবস্থা সম্পর্কে ভীত ছিলেন। বিদ্বান, পণ্ডিত লোকেরা কোপার্নিকাসের দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন এবং তিনি ধর্মীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন।

১৫৪৩ সালের ২৪ মে ৭১ বছর বয়সে তিনি মারা যান। পোল্যান্ডের বাল্টিক কোস্টের ফ্রমবর্ক ক্যাথেড্রালের মেঝের নিচে তাকে সমাহিত করা হয়। নাম-পরিচয়হীনভাবে অবহেলার সাথে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। সে সময়ের ধর্মযাজকেরা কোপার্নিকাসের নতুন তত্ত্ব মেনে না নিলেও পরে তার গবেষণা সত্য প্রমাণিত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

লেখক: কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি

প্রথম প্রকাশ: সংবাদ, ০৫ জুলাই ২০২৫

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কোপার্নিকাস: আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

১৯ জুলাই ১৯৭১: ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর তিন দুঃসাহসিক অভিযান ও অন্যান্য ঘটনা

বিভেদ-বিতর্ক রেখেও ঐক্য গড়া যায়

১৮ জুলাই ১৯৭১: ভারতীয় সেনাপ্রধান হঠাৎ কলকাতায়

১৭ জুলাই ১৯৭১: দেশজুড়ে মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান

১৬ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

জয় বাংলার উচ্ছ্বাস খুঁজি

১৫ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক ঘটনাবহুল দিন

নতুন আতঙ্ক জিকা ভাইরাস : করণীয় কী?

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ভূতের আক্রমণ

১০

মিথ্যা তথ্যের জালে নতুন প্রজন্ম!

১১

জানুয়ারি থেকে জুন, প্রতিদিন ১১ খুন

১২

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি: জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

১৩

১৩ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

১৪

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

১৫

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

১৬

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

১৭

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

১৮

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

১৯

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

২০