ঢাকা সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২০ জুলাই ১৯৭১: বিলমাড়িয়া হাটে গণহত্যা পাকিস্তানি সেনাদের

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৫, ০৭:০৯ পিএম
২০ জুলাই ১৯৭১: বিলমাড়িয়া হাটে গণহত্যা পাকিস্তানি সেনাদের

১৯৭১ সালের ২০ জুলাই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যখন মুক্তিবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংস দমন-পীড়নের ঘটনা একত্রিত হয়েছিল। এই প্রতিবেদনে সেই দিনের ঘটনাবলির একটি বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো, যা বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। এতে সামরিক সংঘর্ষ, রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো সন্নিবেশিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে গঠন করেছিল।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং কূটনৈতিক অবস্থান

২০ জুলাই ১৯৭১ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তাঁর বাসভবনে এক সমাবেশে বক্তৃতা দেন। তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দ্বারা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের উপর নির্বিচারে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। তিনি এই দাবি খণ্ডন করেন যে শুধুমাত্র হিন্দুদের উপরই অত্যাচার চলছে। তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন, যা বাংলাদেশে সংঘটিত মানবিক সংকটের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

একই দিনে, ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সদস্যদের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনী যদি বাংলাদেশের কিছু অংশ পাকিস্তানি দখল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং পাকিস্তান যদি তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে, তবে ভারত আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, যদি বলেন যে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, তবেই বর্তমান সংকটের সমাধান সম্ভব। তিনি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়াকে “পাগলের কাণ্ড” বলে অভিহিত করেন, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা।

একই সময়ে, “সীমান্ত গান্ধী” নামে পরিচিত খান আবদুল গাফফার খান গুজরাটের রাজ্যপালের কাছে একটি চিঠিতে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নৃশংসতার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিশ্বের সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে তামাশার মতো দেখছে। তাদের নীরবতা এর প্রধান প্রমাণ। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের নির্যাতিত ও অসহায় জনগণের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো আন্তরিক সহানুভূতি নেই।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক উন্নয়ন

লাহোরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, তার দল ২৮ জুন থেকে চার মাসের জন্য ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অপেক্ষা করতে রাজি আছে। তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, কোনো ধরনের ছলচাতুরীর মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করা উচিত হবে না। ভুট্টো আরও স্পষ্ট করেন যে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৃহত্তর জোট গঠনের কথা বলেছিলেন যখন শেখ মুজিব সত্যিকারের ফেডারেশনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে শেখ মুজিব ছয় দফার ভিত্তিতে কনফেডারেশনের দাবি উত্থাপন করলে, তিনি জোটের অবস্থান থেকে সরে এসে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ধারণা প্রকাশ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, কিছু লোক তাকে শেখ মুজিবের সমপর্যায়ে আনার চেষ্টা করছে।

ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের মহাসচিব টুংকু আবদুল রহমান করাচিতে বলেন, ১৭ জুলাই তার সঙ্গে আলাপকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আশ্বাস দিয়েছেন যে শরণার্থীরা বিনা শঙ্কায় পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে পারবে। তিনি আরও জানান, ২১ জুন থেকে তিনি ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তান সফরে পাঁচ সদস্যের একটি মিশনের নেতৃত্ব দেবেন, যদিও এই মিশন কোনোভাবেই রাজনৈতিক নয়।

তেহেরিকে ইশতিকলাল পার্টির আহ্বায়ক এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেন, যেসব রাজনৈতিক দলের জাতীয় বৈশিষ্ট্য নেই, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত। তিনি মনে করেন, দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক বিষয়ে মতৈক্য থাকা উচিত।

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযান

২০ জুলাই মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযানগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সকাল ৯টায় এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুবপুর, চন্দ্রপুর ও বাগাবাড়ি অবস্থানে পাকবাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের অবস্থানে ফিরে আসেন।

সকাল সাড়ে ১০টায় কুমিল্লা শহরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন অবস্থানে মর্টার আক্রমণ চালায়। আজাদ স্কুল, সাধনা ঔষধালয়ের কাছে, গোয়ালপট্টি, কালীবাড়ি এবং এসডিও অফিসের কাছে গোলা বিস্ফোরিত হয়। এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে ছোটাছুটি শুরু করে, যা তাদের মনোবল ভেঙে দেয়।

উত্তরাঞ্চলে, বগুড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সার্কিট হাউস ক্যাম্পের উপর বোমা হামলা চালায়, যাতে একজন পাক প্রহরী নিহত হয়। রাজশাহী শহরে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ দল ফুদকিপাড়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি টহলদলকে অ্যামবুশ করে, যাতে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। মেজর গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নাটোরের লালপুর থানা রেইড করে, যাতে ৭ জন অবাঙালি পুলিশ নিহত হয়।

বৃহত্তর সিলেটে, ক্যাপ্টেন হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দিলকুশা চা-বাগানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে একজন পথপ্রদর্শক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ক্যাপ্টেন হক ও মুক্তিযোদ্ধা বাবু আহত হন।

থাকুইরার রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে দিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক মর্টার শেলিং করে। তবে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা ১৭ জন পাকসেনাকে হত্যা করে এবং দখলদার বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে।

পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

২০ জুলাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নাটোর জেলার লালপুরের রামকৃষ্ণপুর গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে এবং আবদুল মন্ডল, বক্স, তাছের মোল্লা, কলি এবং মোজাম্মেলকে হত্যা করে। বিলমাড়িয়া হাট ঘেরাও করে বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গোপালপুর থেকে ধরে আনা ২২ জন যুবককে লালপুর নীলকুঠির কাছে হত্যা করা হয়, এবং কয়েকজনকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়। ডেবরপাড়ার নুরুল ইসলাম মেম্বারকে শান্তি কমিটির বিরোধিতা করার কারণে লালপুর হাইস্কুল মাঠে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আন্তর্জাতিক প্রচার ও সমালোচনা

স্বাধীন বাংলা বেতারে ডাবলিন থেকে প্রকাশিত ‘আইরিশ টাইমস’ পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের বরাত দিয়ে বলা হয়, ইয়াহিয়া খানের বেতার ভাষণে প্রস্তাবিত রাজনৈতিক পরিবর্তন বা রদবদল জঘন্য। তার বেয়নেট-উদ্যত সেনাবাহিনী দিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনীর অত্যাচারে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ যারা দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, তারা এই প্রস্তাবে দেশে ফিরে আসতে পারবে না।

২০ জুলাই ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা এই দিনের ঘটনাগুলোকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়ে পরিণত করেছে। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দৃঢ়তা এবং জনগণের প্রতিরোধের অটল সংকল্পকে তুলে ধরে।

সূত্র:

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর দুই, পাঁচ ও সাত
  • ইত্তেফাক, ২১ জুলাই ১৯৭১
  • আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ২১ ও ২২ জুলাই ১৯৭১
  • শাহাব উদ্দিন মাহমুদ, “২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন”
অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল দাসত্ব: মনোযোগ অর্থনীতি ও জ্ঞান পুঁজিবাদে তরুণ প্রজন্মের মননশীলতার অবক্ষয়

২০ জুলাই, ১৯৭১: বাংলাদেশে কুচক্রী আগ্রাসন

২০ জুলাই ১৯৭১: বিলমাড়িয়া হাটে গণহত্যা পাকিস্তানি সেনাদের

কোপার্নিকাস: আলো হয়ে জন্ম নেওয়া বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তক

১৯ জুলাই ১৯৭১: ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর তিন দুঃসাহসিক অভিযান ও অন্যান্য ঘটনা

বিভেদ-বিতর্ক রেখেও ঐক্য গড়া যায়

১৮ জুলাই ১৯৭১: ভারতীয় সেনাপ্রধান হঠাৎ কলকাতায়

১৭ জুলাই ১৯৭১: দেশজুড়ে মুক্তিবাহিনীর সাহসী অভিযান

১৬ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

১০

জয় বাংলার উচ্ছ্বাস খুঁজি

১১

১৫ জুলাই ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এক ঘটনাবহুল দিন

১২

নতুন আতঙ্ক জিকা ভাইরাস : করণীয় কী?

১৩

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ভূতের আক্রমণ

১৪

মিথ্যা তথ্যের জালে নতুন প্রজন্ম!

১৫

জানুয়ারি থেকে জুন, প্রতিদিন ১১ খুন

১৬

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি: জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি

১৭

১৩ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়

১৮

১২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা, রণনীতি ও কৌশল নির্ধারণে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডার্স সম্মেলন

১৯

১০ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গতিধারা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

২০