ঢাকা সোমবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৯ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
গঙ্গাচড়ার সহিংসতা

রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও সমাজের নীরবতা

সম্মোহন ঋক
২৯ জুলাই ২০২৫, ০৭:০৩ পিএম
২৯ জুলাই ২০২৫, ০৭:১৬ পিএম
রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও সমাজের নীরবতা

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলদাতপুর ছয়আনি হিন্দুপল্লিতে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দাবিকে আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একটি ফেসবুক পোস্টে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে এক কিশোরকে গ্রেপ্তারের পর, উত্তেজিত জনতার হাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় কমপক্ষে ১৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং প্রায় ৫০টি পরিবার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও, ক্ষতিগ্রস্তদের মনে নিরাপত্তার অভাব এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীনতা স্পষ্ট। এই ঘটনা কেবল গঙ্গাচড়ার নয়, বাংলাদেশের সামগ্রিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ব্যর্থতার একটি দুঃখজনক প্রতিচ্ছবি।

ঘটনার পটভূমি

গত শনিবার, গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ী ইউনিয়নে এক কিশোরের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগ ওঠে। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের আগেই পাশের এলাকার একদল মানুষ উত্তেজিত হয়ে প্রথমে ভুলবশত একজনের বাড়িতে হামলা করে। পরে তারা হিন্দুপল্লিতে পরিকল্পিতভাবে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। শংকর রায়, নারায়ণ মহন্ত, কণিকা রানী, রবীন্দ্রনাথ রায়ের মতো ভুক্তভোগীরা তাদের জীবনের সঞ্চয়, গবাদিপশু, এবং মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছেন। কণিকা রানী জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ের বাড়ি থেকে রাখা ১ লাখ টাকা এবং ছেলের জমানো ২০ হাজার টাকা লুট হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি থেকে আসবাবপত্র, গরু, এবং ৫০ হাজার টাকার মতো সম্পদ লুট হয়েছে। এই ঘটনাগুলো শুধু সম্পত্তির ক্ষতি নয়, একটি সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও মর্যাদার উপর আঘাত।

রাষ্ট্রের ভূমিকা ও নীরবতা

গঙ্গাচড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আল এমরান জানিয়েছেন, এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি, এবং অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুলিশের উপস্থিতিতেও হামলা ও লুটপাট ঠেকানো যায়নি। কণিকা রানীর কথায় স্পষ্ট, “পুলিশ থাকিয়াও হামার জীবনে নিরাপত্তা নাই।” এই বক্তব্য রাষ্ট্রের প্রতি একটি গভীর অভিযোগ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান মৃধা ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য শুকনো খাদ্য, টিন, মাটির চুলা, এবং টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু কণিকা রানীর প্রশ্ন, “এই ১০ কেজি চাউল না হয় ১০ দিন খামো, এরপরে?”—এই প্রশ্নের উত্তর কেবল ত্রাণ নয়, ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

রাষ্ট্রের এই দায় এড়ানোর প্রবণতা নতুন নয়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৩৩০ দিনে সংখ্যালঘুদের ওপর প্রায় ২,৫০০টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দোষীদের শাস্তি হয়নি। গঙ্গাচড়ার ঘটনায়ও এখনো কোনো মামলা দায়ের হয়নি, যা ভুক্তভোগীদের মধ্যে হতাশা ও ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

গঙ্গাচড়ার ঘটনা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার একটি পুনরাবৃত্তিমূলক ধরন। নাসিরনগর, রামু, শাল্লা, কুমিল্লার মতো ঘটনাগুলো একই প্যাটার্ন অনুসরণ করে: একটি গুজব বা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট, তারপর উত্তেজক প্রচার, মিছিল, হামলা, এবং লুটপাট। এই চক্রের পুনরাবৃত্তি প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র ও সমাজ এই সমস্যার মূল কারণ মোকাবিলায় ব্যর্থ। রবীন্দ্রনাথ রায়ের বক্তব্যে এই হতাশা প্রকাশ পায়, “মামলা করলে দোষী-নির্দোষী সবাই ফাঁসবে, তখন মামলা দিয়ে সবাই ব্যবসা করবে।” এই কথায় স্পষ্ট, সংখ্যালঘুরা বিচারব্যবস্থার ওপর ভরসা হারিয়েছে।

রাজনৈতিক সুবিধাবাদও এই সহিংসতাকে উসকে দেয়। রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামছুজ্জামান সামু ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর এই ধরনের বক্তব্য প্রায়শই নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হয়ে থাকে, যা ভুক্তভোগীদের জন্য স্থায়ী সমাধান আনে না।

সংখ্যালঘুদের অবস্থান

বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৩.৫%, যা ২০১১ সালে কমে ৮.৫%-এ দাঁড়িয়েছে। এই হ্রাসের পেছনে অভিবাসন, সামাজিক চাপ, এবং সহিংসতার ভয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গঙ্গাচড়ার ঘটনা এই ভয়কে আরও প্রকট করেছে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তারা মামলা করতে ভয় পান, কারণ এটি তাদের আরও বিপদে ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক।

সমাধানের পথ

গঙ্গাচড়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজকে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে:

দ্রুত বিচার: হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। এর জন্য স্বচ্ছ তদন্ত ও মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।

নিরাপত্তার নিশ্চয়তা: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে তারা নিজ বাড়িতে নির্ভয়ে বসবাস করতে পারে।

সামাজিক সচেতনতা: ধর্মীয় উসকানি ও গুজব রোধে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা: রাজনৈতিক দলগুলোকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে এবং এই ইস্যুকে ভোটের রাজনীতির হাতিয়ার না করতে হবে।

ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন: ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য শুধু ত্রাণ নয়, তাদের সম্পদ ও জীবিকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

গঙ্গাচড়ার ঘটনা আমাদের সামনে একটি কঠিন প্রশ্ন তুলেছে: আমরা কি এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে একটি গুজবই একটি সম্প্রদায়ের জীবন ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট? রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু ত্রাণ বিতরণ বা সেনাবাহিনী মোতায়েন নয়, নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা। যতদিন একজন নাগরিকও বলবে, “পুলিশ থাকিয়াও হামার নিরাপত্তা নাই,” ততদিন আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দাবি ফাঁপা বুলি মাত্র। গঙ্গাচড়ার ঘটনা আমাদের সবাইকে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করে—রাষ্ট্র, সমাজ, এবং প্রতিটি নাগরিককে। আমরা যদি এই দায় এড়িয়ে যাই, তবে এই দেশ কখনোই সবার জন্য শান্তির আবাসভূমি হতে পারবে না।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০