ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

স্বাধীনতার অবিনাশী ইতিহাস ও আমরা

হারুন হাবীব
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৫, ০৫:২৮ পিএম
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ

ইতিহাস যথার্থ অর্থে জাতির অহংকার, অর্জন ও ঐতিহ্য। এর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে যুক্তিবাদী মানুষের সঙ্গে বোধহীন প্রাণীর পার্থক্য থাকে না। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা হয় না। কিন্তু কোনো জাতি ইতিহাস-সচেতন না হলে ক্রমান্বয়ে সে বীর্যশূন্য, ঐতিহ্যশূন্য, সভ্যতাবিবর্জিত জনসমষ্টিতে পরিণত হয়।

ইতিহাসে সব জাতিগোষ্ঠীরই কিছু দিকনির্দেশনা থাকে, থাকে এমন অনেক সত্যের খুঁটি গাড়া, যা থেকে ছিটকে পড়া মানেই আপন অহংকারের বৃন্ত থেকে খসে পড়া। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রায় ২০০ বছর ধরে ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছে। এই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক সময়ে আমরা দুই ধরনের মানুষ দেখেছি। এক. এ দেশেরই একশ্রেণির সেবাদাস- যারা নিজের সুবিধার্থে দাসত্বকে বরণ করে নিয়েছে। দুই. অন্যদিকে আরেকটি দল- যারা নিজেদের বর্তমানকে তুচ্ছ করে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করে জাতীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে, এমনকি মৃত্যুবরণ করেছে।

যদিও দুই পক্ষই ইতিহাসের অংশ, তবু ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ হচ্ছে লড়াকু পক্ষকেই ঐতিহ্য বলে বরণ করে নেওয়া। আরও যে শিক্ষা ইতিহাস দেয়, তা হচ্ছে, সেই দাস মনোবৃত্তির মানুষের বিরুদ্ধে সতর্ক থেকে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করা। কারণ ইতিহাস বন্য শাসনব্যবস্থাকে ঘৃণ্য করতে শেখায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে চীনের মাটিতে জাপ বাহিনীর নৃশংসতা চেপে রেখে নানাবিধ বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছিল জাপানি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে। এটি ছিল নতুন প্রজন্মের কাছে জাপানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ঢাকার অপচেষ্টা। কিন্তু সচেতন চৈনিক জাতি ইতিহাসের মিথ্যাচার মেনে নেয়নি। তারা তীব্র প্রতিবাদ করেছে। তীব্র প্রতিবাদ এসেছে কোরিয়ান জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেও। সেই প্রতিবাদের ভাষা এতই প্রবল ছিল যে, সামান্য কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বিতর্কিত জাপানি পুস্তক বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান নাৎসি বাহিনীর বুট, বোমা ও বুলেটে ফ্রান্সের প্যারিস নগরী প্রকম্বিত হয়েছিল। হিটলার বাহিনীর নির্মমতায় রক্তস্নাত হয়েছিল ইউরোপের বহু জনপদ। লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল পোল্যান্ডসহ নানা ইউরোপীয় জনপদে। নাৎসি বাহিনীর প্রবল বোমায় লন্ডন নগরী কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সেই জার্মানির সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক আবারও গড়ে উঠেছে। কারণ সমকালীন বাস্তবতা ও জীবনযাপনের স্বার্থেই সম্পর্কের পুনঃস্থাপন করতে হয়।

কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, জার্মানির এককালীন যুদ্ধবাজ ভূমিকাকে সবাই ভুলে গেছে। হিটলার আজও ইউরোপ তথা বিশ্বের তাবৎ জনগোষ্ঠীর কাছে নিষ্ঠুরতম যুদ্ধবাজ। নাৎসি বাহিনী আজ, হয়তো অনাদিকাল ধরে পরিচিত হবে বর্বর-ফ্যাসিবাদী সেনাবাহিনীর পরিচয়ে।

ইতিহাস গড়ে ওঠে যুগ ও শতাব্দীর বৃহৎ ঘটনাপঞ্জি আশ্রয় করে। ইতিহাসকে নতুন করে লেখা যায় না। বাঙালি এ ভূখণ্ডে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, সে তার ইতিহাস। ধর্ম ও সামরিক ধর্মতন্ত্রের নামে গড়ে ওঠা পাকিস্তানি শাসকের নিপীড়ন শোষণের বিরুদ্ধে গণমানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম পূর্ব বঙ্গের জনইতিহাস। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বাঙালি গণমানুষের রক্তাক্ত লড়াই, যা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, তা আরেক ইতিহাস।

ইতিহাসের শিক্ষা আরও আছে। শুধু ধর্মের বাঁধন থাকলেই এক জাতি হয় না, এর সঙ্গে অনস্বীকার্য যুক্ত ভাষা, সংস্কৃতি ও সম্পদ বণ্টনের গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা। যে পাকিস্তান বাংলাদেশকে ২৪ বছর শাসন ও শোষণ করেছে, নির্যাতন করেছে- সে পাকিস্তানের সঙ্গে যুগের চাহিদাতেই পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে গোড়ামির স্থান নেই। কিন্তু এ সম্পর্ক কখনোই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমাদের বিচ্যুত করতে পারে না। এ সম্পর্ক শোষণের কথা ভুলে নয়, লাখ মানুষের রক্ত ভুলে নয়, ওদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা ভুলে নয়, পাকিস্তানি শাসকদের হাতে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হত্যাকে ভুলে নয়।

তেমনি গণচীনের সঙ্গে আমাদের আধুনিক জীবন গড়ে উঠবে সুসম্পর্কের। কূটনৈতিক বা অর্থনীতির প্রশ্নে হোক, সে সম্পর্ক নিবিড় হবে- সেটিই কাম্য। কিন্তু এ সম্পর্কের নামে জাতি যেন সে ইতিহাস ভুলে না যায় যে, চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মতোই, বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির বিরোধিতা করতে ভেটো পর্যন্ত প্রয়োগ করেছিল!

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করার পেছনে গণচীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের যে যুক্তি ছিল তা কোনো মানবিক বা সভ্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়নি। সৎ ও সত্যের স্বার্থে অবশ্যই মানতে হবে, বৃহৎ শক্তির দুর্ভাগ্যজনক সেই নীতি-অবস্থান আমাদের জাতির ন্যায্য অধিকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। ধর্ম ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে বাংলাদেশের মাটিতে তাদের সেনা ও দেশীয় অনুচরদের নিষ্ঠুরতা সমর্থন করে তারা যে অমানবিকতা দেখিয়েছে, যে অধর্ম করেছে, তাকে আমাদের ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া যাবে না কখনো। এর পরও বলব- এদের সবার সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা যুগের চাহিদাকেই পূরণ করবে।

ভারত শুধু বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ নয়, বাংলাদেশের সীমান্তঘেরা পড়শিও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে ভারতের গণমানুষ ও সরকারের অবদান আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিনির্মাণ হবে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানবোধের ভিত্তিতে। একাত্তরের রক্তমাখা বন্ধুত্ব, যা জাতির স্বাধীনতা লাভে সহায়ক, তাকে অস্বীকার করে ইতিহাস বিস্মৃত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যুক্তি নেই । এটিও মনে রাখা জরুরি যে, পাকিস্তানি গণহত্যা থেকে বাঁচতে ভারতের মাটিতে সেদিনকার পূর্ববঙ্গ বা পূর্বপাকিস্তান থেকে ১ কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিল, হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, যা ইতিহাসের আরেক অধ্যায়।

আমাদের ইতিহাসের বেশকিছু চিরঞ্জীব ইতিহাস স্মারক আছে। আছে ১৬ ডিসেম্বরের মহান বিজয় দিবস, ২৬ মার্চের মহান স্বাধীনতা দিবস, ২৫ মার্চের গণহত্যা দিবস এবং রমনার উদ্যানে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মতো আরও অনেক বড় ঘটনা, যা চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর। এগুলোকে আঘাত করার মানে ইতিহাসকে অমান্য করা।

কারণ স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলে যাওয়া কোনো ঠুনকো বিষয় নয়। এর সৃষ্টি অগণিত গণমানুষের রক্ত-সংগ্রামে, যার পরিণতি আসে ১৯৭১ সালে। অতএব, কোনো সরকারের পতনে বা কারও উত্থানে কখনো এর নড়চড় হতে পারে না। যদি তা করা হয় তা হবে আত্মঘাতী। দেশ ও সমাজ পরিবর্তনশীল, অনস্বীকার্যভাবেই। সরকার যাবে সরকার আসবে। যুগে যুগে গণতন্ত্র উদ্ধার বা সুশাসন লাভে বা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম হবে। এসব ঘটনা কখনো জাতীয় জীবনকে নাড়িয়ে দেবে, কখনো পাল্টে দেবে, কখনো নতুন পথের সন্ধান দেবে। কিন্তু তা কোনোভাবেই জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসকে পাল্টে দিতে পারে না। যারা পালটাতে চান তারা জাতির চলার পথকেই কেবল কণ্টকাকীর্ণ করেন না, বরং বিপন্ন করেন। জানা প্রয়োজন ইতিহাস এক মহাশক্তিধর মহীরুহ, তাকে অবজ্ঞা করা যায় না। কারণ এর অন্তর্নিহিত মহাশক্তিই ইতিহাসের ঘাতকদের প্রতিহত করে, পর্যুদস্ত করে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যারা বিকৃত করতে চান তারা দেশপ্রেমিক নন। নানা মত ও পথে বিভক্ত হয়েও দেশপ্রেমিক হওয়ার প্রধান শর্ত- জাতীয় ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা, যিনি তার বন্দিদশায় সাময়িক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি, সর্বাধিনায়ক। অতএব, সেই শেখ মুজিবকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব নয় কখনো। যদি কেউ তা করতে চান তারা জাতির চলার পথকেই কেবল কণ্টকাকীর্ণ করেন না, একই সঙ্গে বিপন্ন করেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সাফল্য ও সমালোচনা মেনে নিতে হবে। প্রবল ষড়যন্ত্র চলেছে সদ্য যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। একদিকে পরাশক্তি আমেরিকার প্রতিশোধস্পৃহা, অন্যদিকে দেশের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী এবং পরাজিত বাহিনীর দোসরদের অপতৎপরতা, যার সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রগতিবিরোধী চক্র আবারও জায়গা করে নিয়েছে। একপর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা বিপন্ন হয়েছে।

স্বাধীনতার বয়স এরই মধ্যে পাঁচ দশকেরও বেশি হয়েছে। একাত্তরের পরে জন্ম লাভ করা শিশুও আজ পরিপূর্ণ মানুষ। নানা বিপণ্নতার পরও বাংলাদেশ বেশ খানিকটা এগিয়েছে। অগ্রগতি ঘটেছে যোগাযোগ, উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে। জ্ঞানবিজ্ঞান, সামাজিক সূচক ও খেলাধুলায় বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। এর পরও শঙ্কার কারণ আছে। এর প্রধান কারণ জাতির মনোজগতে নতুন করে কলঙ্ক বিছিয়ে চলেছে ধর্মান্ধতা ও উগ্র সাম্প্রদয়িকতা! একই সঙ্গে থাবা বিস্তার করেছে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। এ এক দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা যাকে অস্বীকার করা হলে বা আত্মতুষ্ট হলে, সব অর্জন ব্যর্থ হবে।

নতুন নাগরিকদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে, যে মূল্যবোধ ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একাত্তরের সফল মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, তার যেন পতন না ঘটে। দেখতে হবে, কী সেই চেতনা কিংবা আদর্শ যাকে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে এ মাটির লাখ লাখ যুবক রাইফেল ধরেছিল, মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল, জীবন উৎসর্গিত করেছিল। কারণ, যে দেশের জন্ম রক্তাক্ত সংগ্রামে, সেই সংগ্রামের আদর্শকে নির্বাসিত করে আর যা-ই হোক- বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একাত্তরের বিজয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের প্রত্যাশার শ্রেষ্ঠতম অর্জন।

এ ভূখণ্ডের মানুষ বিদেশি ও স্বদেশি শোষণের মাঝে বসবাস করে এসেছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। সামন্তপ্রভুদের নির্যাতনও আমাদের ইতিহাসের অংশ। মনে রাখতে হবে, শত বছরের চেষ্টা ও রক্তপাতের পরও বাঙালি কখনোই স্বাধীনতার মুখ দেখেনি ১৯৭১-এর আগে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অর্থ এই ভূখণ্ডের মুক্তিকামী মানুষের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম স্বদেশভূমি বিনির্মাণের সাধনা এবং সেই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখা।

আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও তার চেতনার কথা বলি, তখন ভাবতে হবে, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকে ভাঙতে হয়েছিল কেন? কেন বাঙালিকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও তার সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছিল? নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই জানতে হবে, কী ছিল সেই বঞ্চনা ও নিষ্পেষণের ইতিহাস, যা জাতিকে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করেছিল।

বুঝতে হবে, কোন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের মাটিতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা পেয়েছিল বাঙালি, ধর্মের দোহাই দিয়েও যা টিকিয়ে রাখা যায়নি। কারণ একই দেশে বসবাস করে কেবল ধর্মের নামে সংখ্যালঘু একটি সম্প্রদায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে শোষণ করবে, অপমানিত করবে এবং মর্যাদাহীন করে তুলবে, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটিও জানতে হবে কেন এ দেশেরই একশ্রেণির ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মানুষ জাতীয় স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে বর্বর দখলদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গণহারে হত্যা ও নারী নির্যাতনে যোগ দিয়েছিল!

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা জাতির মূল সংবিধানে গ্রন্থিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মাথায়। এ ছিল এক বিস্ময়কর জাতীয় সাফল্য। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। মূলত এ বিষয়গুলোকেই সংক্ষিপ্ত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বলতে পারি, যদিও পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান-পতনে অনেকেই এর ভিন্ন বিশ্লেষণে গিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের চেষ্টা করেছেন।

দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার রক্তার্জিত মূল্যবোধগুলোকে পরবর্তী সময়ে নির্বাসিত করা হয়েছিল। যে কারণগুলোর জন্য এ দেশের লাখো তরুণ অস্ত্র হাতে তুলে শহিদ হয়েছেন, লাখো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, লাখো নারী নির্যাতিত হয়েছেন- সে কারণগুলো সর্বত্রই উপেক্ষিত থেকেছে বহুকাল। গণতন্ত্রের চেহারা যে কী করুণ হয়েছিল তা আমরা দেখেছি। সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত ছিল না, জাতীয়তাবাদ পর্যন্ত বিতর্কিত করা হয়েছিল। শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যাশা পরিণত হয়েছিল দিবাস্বপ্নে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। অতএব, প্রয়োজন নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের বর্মে, দেশপ্রেমের বর্মে দীক্ষিত করা।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও চিন্তাবিদ

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শহীদ বুদ্ধিজীবী / এ কে এম সিদ্দিক বিশ্বাস

শহীদ বুদ্ধিজীবী / কোরবান আলী

শহীদ বুদ্ধিজীবী / শান্তিময় খাস্তগীর

শহীদ বুদ্ধিজীবী / এ কে এম মনিরুজ্জামান

১০ বছরে সর্বনিম্ন বিনিয়োগ, স্থবির অর্থনীতি

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন

ধর্মান্ধতার শিকার প্রান্তিক নারীজীবনের কথাশিল্পী বানু মুশতাক

আইএমএফের পরামর্শ / ডলারের দাম বাজারীকরণের বিপদ

সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা

ভ্রমণপ্রেমী গভর্নরের নয় মাসে ৬৫ দিন বিদেশ সফর

১০

বাজেটে স্বস্তি নেই মধ্যবিত্তের

১১

কোদালিয়া গণহত্যা / নগরকান্দার রক্তঝরা ইতিহাস

১২

১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

১৩

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

১৪

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

১৫

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

১৬

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

১৭

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

১৮

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

১৯

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

২০