ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা
আইএমএফের পরামর্শ

ডলারের দাম বাজারীকরণের বিপদ

মইনুল ইসলাম
০১ জুন ২০২৫, ০৪:৪০ পিএম
০১ জুন ২০২৫, ০৪:৪৫ পিএম
ডলার
ডলার

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ৪.৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়ের জন্য ডলারের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অনেকদিন ধরে তাদের এই শর্ত মানতে নারাজ ছিলেন। তাদের মত ছিল, এখন ডলারের দাম নির্ধারণ পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে এগ্রিগ্রেটর ও ম্যানিপুলেটরদের তাণ্ডবে হু-হু করে ডলারের দাম বেড়ে ১৭০-১৮০ টাকায় পৌঁছে যেতে পারে। এখন বাংলাদেশে ডলারের দাম ১২২-১২৩ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে।

গভর্নর বলছেন, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে বিপদে পড়েছে, পাকিস্তানে এক ডলারের দাম ২৮০ রুপি এবং শ্রীলঙ্কায় ৪০০ রুপি। আমিও আইএমএফের এই শর্তের বিরোধী। কিন্তু ১৫ মে তারিখের পত্রপত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, অবশেষে আইএমএফের শর্ত মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে, জুনে আইএমএফের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১.৩ বিলিয়ন ডলার পেয়ে যাবে বাংলাদেশ।

২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ অভিবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন ও কর্মরত রয়েছেন। তারা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১.৬১ বিলিয়ন ডলার ফরমাল চ্যানেলে দেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা সামান্য বেড়ে ২৩.৪১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স প্রবাহ ২৯-৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই বাড়তি রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামানো গেছে, ডলারের দাম ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রাখা গেছে এবং ব্যালান্স অব পেমেন্টসের চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি প্রায় দূর করা সম্ভব হয়েছে। হুন্ডি প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় এখন হুন্ডি বাজারে ডলারের দাম ১২৩-১২৪ টাকার বেশি হচ্ছে না, যার ফলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারা শক্তিশালী রয়েছে।

অথচ ২০২৪ সালের জুনের পর বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে কোনো ঋণের অর্থ পায়নি। এ প্রেক্ষাপটে আইএমএফের ঋণের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা, সে প্রশ্নই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হুন্ডি পদ্ধতির জনপ্রিয়তা রয়েছে। ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য সরকার আগে ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিত, সম্প্রতি এই প্রণোদনাকে ৫ শতাংশে বাড়ানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রবাসীদের ফরমাল চ্যানেলগুলো ব্যবহারে যথেষ্ট উৎসাহিত করা যাচ্ছিল না। কারণ হুন্ডি প্রক্রিয়ায় পুঁজি পাচারের চাহিদা শক্তিশালী থাকলে হুন্ডিওয়ালারাও ডলার কেনার সময় ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়ে হুন্ডির আকর্ষণ ধরে রাখার চেষ্টা করত। আমার দৃঢ় অভিমত হলো, হুন্ডি ব্যবস্থার চাহিদা কাঠামোতে অবস্থানকারী পুঁজি পাচারকারীদের প্রতি সরকারের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু পতিত শাসকের কর্তাব্যক্তিরা, তাদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজন এবং ওই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলা প্রায় সবাই পুঁজি পাচারে সক্রিয় থাকায় পুঁজি পাচার দমনে সরকারের কোনো কঠোর প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়নি। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে হুন্ডিতে ডলারপ্রতি প্রবাসীরা বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত বাজারের ডলারের দামের চাইতে ৫-৭ টাকা বেশি পাচ্ছিলেন। যেহেতু বিশ্বস্ততাই হুন্ডি ব্যবসার সাফল্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তাই সাধারণত রেমিট্যান্সের টাকা মার যায় না; লেনদেনের গোপনীয়তাও রক্ষা করা হয় সযতনে। প্রবাসীদের জন্য হুন্ডি পদ্ধতির সাধারণ সুবিধাগুলোর সঙ্গে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে পাল্লা দেওয়া সুকঠিন।

হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত অর্থ প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের ভোগ, সঞ্চয় ও বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখত। এক কোটি টাকার বেশি আমানত রক্ষাকারী ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দেশে এখন ১ লাখ ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং এসব অ্যাকাউন্টের উল্লেখযোগ্য অংশই গ্রামীণ এলাকার ব্যাংক শাখাগুলোতে।

বিবেচনা করুন, সারাদেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রবাসীদের পরিবারের পাকা বাড়ি নির্মাণের যে হিড়িক চলেছে, তার খরচের কত শতাংশ ফরমাল চ্যানেলে দেশে এসেছে? স্বীকার করতেই হবে, ফরমাল চ্যানেল বা হুন্ডি পদ্ধতি যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক, তার বহুবিধ সুফল পাচ্ছে অর্থনীতি। হুন্ডি পদ্ধতিতে পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতির জন্য পুরোপুরি নেতিবাচক নয়। এক অর্থে এই বিপুল রেমিট্যান্সের অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। চীন ও ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ যে ভূমিকা পালন করেছে, তার অনুরূপ ভূমিকা বাংলাদেশে পালন করছে ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাংলাদেশের অনেক এলাকার গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে যে বিপুল গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে প্রধানত অবদান রেখে চলেছে এলাকার প্রবাসী-বাংলাদেশির সংখ্যাধিক্য।

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আবার যদি হুন্ডিওয়ালাদের দাপট বাড়তে শুরু করে তাহলে ডলারের দাম ১২২ টাকায় স্থিতিশীল রাখা যাবে না। সে জন্য আমি মনে করি, ডলারের দাম নির্ধারণ এখনই বাজারের হাতে ছেড়ে না দিলে ভালো হতো। স্বৈরশাসন উৎখাতের পর মাত্র কয়েকজন ছাড়া উল্লিখিত লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারী প্রায় সবাই নানাভাবে দেশ থেকে বিদেশে পালিয়ে গেছে। কয়েক লাখ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে এসব পলাতক লুটেরা একেকজন দেশের আন্তর্জাতিক সীমানার নানা গোপন পথে বিজিবি-বিএসএফ এবং সংগঠিত চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের মদদে প্রধানত ভারতে পাড়ি দিয়েছে। ৯ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখন তাদের বেশির ভাগেরই সাময়িক অর্থ সংকটে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতএব, তাদের পরিবারের সদস্য-সদস্যা ও আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় তাদের বিদেশে অবস্থানের অর্থায়ন সংকট কাটানোর জন্য ওইসব দেশে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ তাদের জন্য প্রয়োজন হওয়াই স্বাভাবিক। এদের কারণে আবার হুন্ডি ব্যবসা চাঙ্গা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় গত সাড়ে ৯ মাসে ২৭ হাজার সন্দেহজনক লেনদেনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। সাধু সাবধান!

ড. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শহীদ বুদ্ধিজীবী / এ কে এম সিদ্দিক বিশ্বাস

শহীদ বুদ্ধিজীবী / কোরবান আলী

শহীদ বুদ্ধিজীবী / শান্তিময় খাস্তগীর

শহীদ বুদ্ধিজীবী / এ কে এম মনিরুজ্জামান

১০ বছরে সর্বনিম্ন বিনিয়োগ, স্থবির অর্থনীতি

২ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন

ধর্মান্ধতার শিকার প্রান্তিক নারীজীবনের কথাশিল্পী বানু মুশতাক

আইএমএফের পরামর্শ / ডলারের দাম বাজারীকরণের বিপদ

সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা

ভ্রমণপ্রেমী গভর্নরের নয় মাসে ৬৫ দিন বিদেশ সফর

১০

বাজেটে স্বস্তি নেই মধ্যবিত্তের

১১

কোদালিয়া গণহত্যা / নগরকান্দার রক্তঝরা ইতিহাস

১২

১ জুন ১৯৭১: নগরকান্দা গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

১৩

মানুষ কার কাছে আশ্রয় চাইবে

১৪

আজহারুল ইসলামের রায়: বিচারের মানদণ্ড নাকি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন?

১৫

অভয়নগরের ভয়, আমাদের পিছু ছাড়ছে না

১৬

চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি ইজারাদারি: আয় প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা বনাম হুমকি

১৭

৩১ মে ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকাল

১৮

দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির সংকট ও ‘থ্রি এম’ সমাধান

১৯

২৯ মে, ১৯৭১: বরগুনার গণহত্যা, আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা

২০