বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য একটি ‘‘মানবিক করিডোর” স্থাপনে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে। জাতিসংঘের অনুরোধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, এটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—এই করিডোর আসলে কার স্বার্থে? বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এটি কতটা সহায়ক হবে, নাকি ভবিষ্যতে নতুন সংকটের দরজা খুলে দেবে?
জাতিসংঘের প্রস্তাব ও সরকারের অবস্থান
জাতিসংঘের মতে, রাখাইনে চলমান গৃহযুদ্ধ ও অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে খাদ্য ও ওষুধের মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছে। দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় তারা বাংলাদেশের মাধ্যমে একটি মানবিক করিডোর চালুর অনুরোধ জানায়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন নীতিগতভাবে সম্মতি দিলেও কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, যা এখনো অস্পষ্ট। অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আলোচনা করেনি, তবে লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
এই দ্বিধাবিভক্ত বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, সরকারের মধ্যেই এই ইস্যুতে পরিষ্কার নীতিগত ঐক্যমত্য নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এমন একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দল, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং জনগণের মতামত কেন নেওয়া হলো না?
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া: নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রশ্নৎ
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের প্রধান আপত্তিগুলো হলো:
অনির্বাচিত সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত: একটি অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “এটি আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। সরকারের উচিত ছিল সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা।”
সামরিকীকরণের আশঙ্কা: বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে মানবিক করিডোর শেষ পর্যন্ত সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। বসনিয়া, সিরিয়া বা ইউক্রেনের উদাহরণ দেখলে স্পষ্ট—এ ধরনের করিডোর কখনোই শুধু "মানবিক" থাকে না। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন সতর্ক করেছেন, "এটি একদিন সামরিক করিডোরে পরিণত হতে পারে।"
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রভাব: বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। করিডোর দেওয়ার অর্থ কি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনো গ্যারান্টি পাওয়া যাবে? নাকি এটি নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পথ সুগম করবে?
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: মানবিক করিডোরের ব্যর্থ ইতিহাস
ইতিহাস বলে, মানবিক করিডোর প্রায়ই অপ্রত্যাশিত পরিণতি ডেকে আনে।
লাচিন করিডোর (আজারবাইজান-আর্মেনিয়া): শুরুতে মানবিক সহায়তার জন্য খোলা হলেও পরে এটি অস্ত্র ও সম্পদ পাচারের রুটে পরিণত হয়। ২০২৩ সালে আজারবাইজান করিডোর বন্ধ করে দিলে হাজারো আর্মেনীয় বাস্তুচ্যুত হয়।
স্রেব্রেনিকা নিরাপদ এলাকা (বসনিয়া): জাতিসংঘের ঘোষিত এই করিডোর শেষ পর্যন্ত গণহত্যার স্থান হয়ে ওঠে। ডাচ শান্তিরক্ষীরা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, এবং সার্ব বাহিনী ৮,০০০ মুসলিম নাগরিককে হত্যা করে।
সিরিয়ার নিরাপদ অঞ্চল: যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমর্থনে তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে পরিণত হয়।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে, মানবিক করিডোর প্রায়ই রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থের বলি হয়। বাংলাদেশ কি একই ভুল পুনরাবৃত্তি করতে চলেছে?
মিয়ানমারের জটিল রাজনীতি: কার সঙ্গে আলোচনা?
রাখাইন বর্তমানে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও আলোচনা জরুরি। সমস্যা হলো:
জান্তা সরকার রোহিঙ্গাবিরোধী: তারা কখনোই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেবে না।
আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাবিরোধী: তারা রাখাইনের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মনে করে।
চীন ও ভারতের ভূরাজনৈতিক খেলা: চীন মিয়ানমারের জান্তাকে সমর্থন করে, আর ভারত আরাকান আর্মিকে পরোক্ষ সহায়তা দেয়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়াবে?
বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি
নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ: রাখাইনের সহায়তা পৌঁছালেও সেখানকার রোহিঙ্গারা যদি বাংলাদেশে আসার সুযোগ পায়, তাহলে শরণার্থী সংকট আরও তীব্র হবে।
সীমান্তে অস্থিরতা: আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ বাংলাদেশের সীমান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফাঁদ: কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই করিডোর যুক্তরাষ্ট্রের "বার্মা অ্যাক্ট" বাস্তবায়নের অংশ হতে পারে, যা এই অঞ্চলে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে সাহায্য করবে।
সরকারের কী করা উচিত?
সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা: জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।
শর্তগুলো প্রকাশ করা: করিডোরের শর্ত কী, কী ধরনের পণ্য যাবে, কে নিয়ন্ত্রণ করবে—এসব তথ্য জনগণ জানার অধিকার রাখে।
বিকল্প পথ বিবেচনা: সমুদ্রপথে বা মিয়ানমারের অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে সাহায্য পাঠানো যায় কি না, তা দেখা দরকার।
চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সমন্বয়: মিয়ানমারে তাদের প্রভাব ব্যবহার করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চাপ তৈরি করা যেতে পারে।
মানবিক সহায়তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, কিন্তু যখন তা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত, তখন সতর্কতা জরুরি। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার মূল্য দিচ্ছে। এখন যদি এই করিডোরের নামে নতুন কোনো জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার দায়ভারও বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে।
সরকারের উচিত, এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে সামগ্রিক পরিকল্পনা করা। নইলে এই “মানবিক করিডোর” একদিন বাংলাদেশের জন্য "অমানবিক বিপর্যয়" ডেকে আনতে পারে।
মন্তব্য করুন