ঢাকা সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বনাম প্রেস সচিব: বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটে সরকার

সম্মোহন ঋক
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৫, ০৫:৫৮ পিএম
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বনাম প্রেস সচিব: বিশ্বাসযোগ্যতা সংকটে সরকার

সরকারের উচ্চপর্যায়ের দুই মুখপাত্র—পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. মো. তৌহিদ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম—সম্প্রতি একই ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। মিয়ানমারের সাথে মানবিক করিডোর ইস্যুতে তাদের এই দ্বিমুখী অবস্থান সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। এই প্রতিবেদনে বক্তব্যের পার্থক্য, সম্ভাব্য কারণ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হলো।

ঘটনাক্রম: কে কী বলেছে

১. পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য (২৮ এপ্রিল) “মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে নীতিগতভাবে করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।”

“কিছু শর্ত আছে, যা এখন প্রকাশ করা যাবে না।”

২. প্রেস সচিবের বক্তব্য (২৯ এপ্রিল) “কক্সবাজার দিয়ে মানবিক করিডোর স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সাথে আলোচনা হয়নি।”

“জাতিসংঘের নেতৃত্বে সহায়তা পাঠানো হলে লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত।”

বিশ্লেষণ: কেন এই বিভ্রান্তি?

১. যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা সরকারের অভ্যন্তরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকতে পারে। একটি সংবেদনশীল বৈদেশিক নীতির বিষয়ে দুটি অফিস আলাদা তথ্য দিলে তা জনমনে সংশয় তৈরি করে।

২. রাজনৈতিক চাপ মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক জটিল একটি বিষয়। করিডোর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ (জাতিসংঘ) ও অভ্যন্তরীণ চাপ (রোহিঙ্গা ইস্যু) সামলাতে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত বক্তব্য আসতে পারে।

৩. তথ্য নিয়ন্ত্রণের কৌশল কূটনৈতিক স্পর্শকাতরতায় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট বার্তা দিতে চাইতে পারে। তবে এটি জনগণের কাছে "গোপনীয়তার সংস্কৃতি" হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

বিরোধী দলগুলোর অবস্থান

বিএনপি: “সরকারের ভেতরে বিশৃঙ্খলা। জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।” — মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জামায়াতে ইসলামী: “করিডোরের পেছনে কোনো গোপন এজেন্ডা থাকলে তা প্রকাশ করতে হবে।” — ড. শফিকুর রহমান।

নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন

ড. দেলোয়ার হোসেন (রাজনৈতিক বিশ্লেষক): “একই সরকারের দুই উচ্চপদস্থ ব্যক্তির বক্তব্যে এত পার্থক্য গ্রহণযোগ্য নয়। এটি শীর্ষ পর্যায়ের সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত।”

ড. তাসনিম সিদ্দিকী (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ): “মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থান অস্পষ্ট হলে আঞ্চলিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে।”

ইতিহাসে এমন বিভ্রান্তির নজির ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ভিন্ন বক্তব্য এসেছিল।

২০২১ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপ বন্ধ: পর্যটন মন্ত্রণালয় ও নৌবাহিনীর বক্তব্যে পার্থক্য ছিল।

সরকারের সম্ভাব্য ক্ষতি

১. আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস: জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হতে পারে। ২. অভ্যন্তরীণ আস্থার সংকট: জনগণের মধ্যে সরকারের তথ্য প্রদানে আস্থা কমছে। ৩. রাজনৈতিক সুবিধা হারানো: বিরোধী দলগুলো এই বিভ্রান্তিকে "সরকারের অদক্ষতা" হিসেবে ব্যবহার করছে।

কী করা উচিত?

১. স্পষ্ট নীতিনির্ধারণী ঘোষণা: প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থান জানানো হোক। ২. সমন্বয় বৃদ্ধি: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রেস সচিব ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়মিত বৈঠক করা প্রয়োজন। ৩. তথ্যের স্বচ্ছতা: শর্তগুলো প্রকাশ করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য তথ্যের স্বচ্ছতা ও সমন্বয় অপরিহার্য। পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শুধু বিভ্রান্তিই নয়, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের কার্যকারিতাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে। সরকারের উচিত, দ্রুত এই সংকট কাটিয়ে ওঠা।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাসনাবাদ গণহত্যা: লাকসামের অমানবিক অধ্যায়

পোমরা গণহত্যা: মুক্তিযুদ্ধের এক অমানবিক অধ্যায়

১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন

১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতীক

১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন

কৃষ্ণপুর-ধনঞ্জয় গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর)

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ভুটানের রাজার শরণার্থীশিবির পরিদর্শন, অপ্রত্যাশিত সমর্থন

শোভনা গণহত্যা (খুলনা)

উদয়পুর গণহত্যা (মোল্লাহাট, বাগেরহাট)

১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ

১০

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন

১১

ঘোড়াইল গণহত্যা (কেন্দুয়া, নেত্রকোনা)

১২

৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক চাপ এবং গেরিলা অভিযানের দিন

১৩

কাঁঠালতলা গণহত্যা (ফকিরহাট, বাগেরহাট)

১৪

সাভিয়ানগর গণহত্যা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এক নৃশংস অধ্যায়

১৫

গোয়ালগ্রাম বধ্যভূমি: মুক্তিযুদ্ধের এক ভয়াবহ গণহত্যা (দৌলতপুর, কুষ্টিয়া)

১৬

গুরই গণহত্যা: একটি ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি (নিকলী, কিশোরগঞ্জ)

১৭

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: কলকাতা মিশন হলো বাংলাদেশ হাইকমিশন

১৮

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ইকরদিয়া গণহত্যা – এক নির্মম অধ্যায়

১৯

৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযান, বিভিন্ন সেক্টরে আক্রমণ

২০