গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি হিসাবে ১ লাখ ১৩ হাজার নতুন রোহিঙ্গা প্রবেশ করলেও মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রকৃত সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে। শুধুমাত্র গত ২৪ ঘণ্টায় উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত চেকপোস্টে প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ নথিবদ্ধ হয়েছে।
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (UNHCR) বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রাখাইন রাজ্যে “মানবিক করিডোর” স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নীতিগতভাবে এই প্রস্তাবে সম্মতি জানালেও বিষয়টির গভীর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এই প্রবন্ধে আমরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে চীন ও মিয়ানমারের সরকারি বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখব কেন এই করিডোর বাংলাদেশের জন্য একটি বিপজ্জনক ফাঁদ।
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি
গৃহযুদ্ধ, আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকারের নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বর্তমানে তিনটি শক্তির মধ্যে সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে:
মিয়ানমার সামরিক জান্তা (State Administration Council - SAC)
আরাকান আর্মি (Arakan Army - AA) - স্থানীয় রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহী গ্রুপ
রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী - যাদেরকে মিয়ানমার সরকার নাগরিকত্ব দেয়নি
আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধিত শক্তি
সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম The Irrawaddy এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে আরাকান আর্মি রাখাইনের ৬০% এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তারা স্থানীয় প্রশাসন চালাচ্ছে এবং কর আদায় করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের দমনের জন্য রাখাইনে নৌ-অবরোধ জারি করেছে, যার ফলে খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানিসহ সকল মানবিক সহায়তা বন্ধ রয়েছে।
মানবিক করিডোরের গন্তব্য
জাতিসংঘের প্রস্তাবিত করিডোরের মাধ্যমে পাঠানো সহায়তা কার্যত আরাকান আর্মির হাতে যাবে, কারণ তারা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক শক্তি। মিয়ানমারের সরকারি সংবাদমাধ্যম Global New Light of Myanmar ইতিমধ্যেই এই করিডোরকে "বিদ্রোহীদের সমর্থন" হিসেবে নিন্দা করেছে।
বাংলাদেশের জন্য ৫টি বড় ঝুঁকি
১. মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা
মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে বাংলাদেশের কাছে একটি সরকারি নোট ভার্বাল পাঠিয়েছে, যাতে সতর্ক করে বলা হয়েছে--
"আরাকান আর্মিকে কোনো ধরনের সহায়তা প্রদান মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।"
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র People's Daily এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে:
"পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চায়। বাংলাদেশকে এই গেমে ব্যবহার করা যাবে না।"
২. নতুন রোহিঙ্গা ঢল ও বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর চাপ
মালয়েশিয়াভিত্তিক সংবাদপত্র The Star এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের উপর চাপ প্রয়োগ করছে যাতে তারা বাংলাদেশে চলে যায়। এর ফলে আগামী ৬ মাসে আরও ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।
৩. মার্কিন-চীন প্রভাবের লড়াইয়ে বাংলাদেশের জড়িয়ে পড়া
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই আরাকান আর্মিকে "মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ" হিসেবে সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে চীন এই করিডোরকে "আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি" হিসেবে দেখছে।
৪. জামাত-শিবিরের ইসলামী রাষ্ট্র প্রস্তাব
বাংলাদেশের জামাতে ইসলামী সম্প্রতি চীনা দূতাবাসের সাথে বৈঠক করে রাখাইনে একটি "ইসলামী রাষ্ট্র" গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত প্ররোচনামূলক পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে বিব্রত করবে।
৫. অনির্বাচিত সরকারের ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত
বর্তমান সরকারের কোনো জনগণের ম্যান্ডেট নেই। এমন একটি স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত সংসদীয় বিতর্ক ছাড়াই নেওয়া হচ্ছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার লঙ্ঘন।
বাংলাদেশের জন্য বিকল্প পথ
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা জরুরি: এই করিডোর চালু করতে হলে প্রথমে এটি নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপন করতে হবে।
চীন ও আসিয়ানের সাথে সমন্বয়: মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ব্যবহার করে কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে।
সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার: নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে অবিলম্বে সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
এই করিডোর বাংলাদেশকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে দেবে, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। এখনই সময় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও জনসচেতনতা গড়ে তোলার।
সূত্র
The Irrawaddy (মিয়ানমার)
Global New Light of Myanmar (মিয়ানমার সরকারি মিডিয়া)
People's Daily (চীন)
The Star (মালয়েশিয়া)
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ নথি
মন্তব্য করুন