ঢাকা বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ৬ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

পাগলা দেওয়ান মসজিদ গণহত্যা

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
১৮ জুন ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম
২৩ জুন ২০২৫, ০৪:৫৫ পিএম
মুসল্লিরা জুমার নামাজ আদায় করছিলেন। নামাজের খুতবা চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় মসজিদগুলো ঘিরে ফেলে এবং ৪০ নিরস্ত্র মুসল্লিকে হত্যা করে | ছবি: ‍প্রিয়ভূমি

১৯৭১ সালের ১৮ জুন, শুক্রবার, জয়পুরহাট সদরের পাগলা দেওয়ান মসজিদে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা এক নির্মম গণহত্যা চালায়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ৪০ জন নিরীহ মুসল্লি শহীদ হন। এটি ছিল জয়পুরহাটের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রতিশোধমূলক হামলা।

পটভূমি: জয়পুরহাটে পাকিস্তানি বর্বরতার সূচনা

২৫ মার্চের গণহত্যা ও ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ান, চিরলা, ভুটিয়াপাড়া, নওপাড়া, পাহনন্দাখাসপাহনন্দা এলাকার যুবকেরা ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা এ তথ্য জানতে পেরে এলাকাবাসীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

১৮ জুনের ভয়াবহ ঘটনা: জুমার নামাজে হামলা

সেদিন শুক্রবার হওয়ায় পাগলা দেওয়ান ও আশেপাশের মসজিদগুলোতে মুসল্লিরা জুমার নামাজ আদায় করছিলেন। নামাজের খুতবা চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় মসজিদগুলো ঘিরে ফেলে এবং নিরস্ত্র মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়:

  • মুসল্লিদের গালিগালাজ করে মসজিদ থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনা হয়।

  • প্রায় ৩০০ জনকে রশি দিয়ে বেঁধে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

  • তাদের মধ্যে থেকে ৪০ জনকে বেছে নেওয়া হয় নির্মম হত্যার জন্য। বাকিদের জোরপূর্বক বাংকার খনন ও সেনা কাজে ব্যবহারের হুমকি দেওয়া হয়।

নিষ্ঠুরতম হত্যার বিবরণ

  • শিক্ষক বাহার উদ্দিন (ধলাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়) প্রতিবাদ করায় তাকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়।

  • বাকি ৩৯ জনকে বুক সমান গভীর গর্ত খনন করতে বাধ্য করা হয়।

  • একে একে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়।

  • আহত অবস্থায় আবেদ আলী, সোলায়মান আলী দেওয়ান, মোজাম্মেল, মোজাফফর, খোকা প্রমুখ বেঁচে যান এবং পরবর্তীতে গণহত্যার সাক্ষ্য দেন।

শহীদদের তালিকা (যাদের নাম জানা গেছে)

নাম গ্রাম
আনেস আলী মণ্ডল চকবরকত
মফিজউদ্দিন ও গইমুদ্দিন (দুই ভাই) চিরলা
নাজির উদ্দিন পাহনন্দা
বাহার উদ্দিন মাস্টার ধলাহার
কসিম উদ্দিন পাহনন্দা
গানা সরদার পাহনন্দা
আহমেদ ও মোহাম্মদ আলী চিরলা
সিরাজুল নিধি
মমতাজ, বাহার উদ্দিন সরদার, নিঝুম সরদার চকবরকত

অনেকের নামই অজানা থেকে গেছে।

গণহত্যার পরবর্তী ঘটনা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব

এই হত্যাকাণ্ডের পর এলাকাবাসী আরও দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। জয়পুরহাটের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গেরিলা আক্রমণ তীব্রতর হয়।

ইতিহাসের নির্মম সাক্ষ্য

পাগলা দেওয়ান মসজিদ গণহত্যা শুধু একটি স্থানের трагеই নয়— এটি ১৯৭১ সালের গণহত্যার একটি প্রতীকী ঘটনা, যেখানে ধর্মীয় স্থানেও পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমতা চালিয়েছে। আজও এই দিনটি জয়পুরহাটবাসীর মনে গভীর ক্ষত রেখে গেছে।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (৫ম খণ্ড), স্থানীয় সাক্ষাৎকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণা।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০