১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক কলঙ্কিত অধ্যায় হলো ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার কোদালিয়া গণহত্যা। চাঁদহাট যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ৩০ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত তিন দিন ধরে তারা নগরকান্দার কোদালিয়া ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। এই গণহত্যায় ২০০-এর বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হন, যার মধ্যে ১৮ জন নারী একসাথে মাদ্রাসা মাঠে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন।
ঘটনার পটভূমি: চাঁদহাট যুদ্ধ ও পাকিস্তানিদের প্রতিশোধস্পৃহা
২৯ মে: চাঁদহাট যুদ্ধ
মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনতা চাঁদহাটে পাকিস্তানি সেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে।
ঘোড়ামারা বিল, দিঘলিয়া বিল ও দমদম খালে সম্মুখযুদ্ধে ২৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই পাকিস্তানিরা ফরিদপুর, মুকসুদপুর, ভাঙ্গা ও কাশিয়ানী থেকে অতিরিক্ত সেনা এনে কোদালিয়া ঘিরে ফেলে।
৩০ মে - ১ জুন: কোদালিয়ায় নৃশংস গণহত্যা
১. গ্রামবাসীদের জোরপূর্বক জমায়েত
পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় কোদালিয়ার বাসিন্দাদের মাদ্রাসা মাঠে জড়ো করে।
লোকজনকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়:
প্রথম গ্রুপ: বয়স্ক পুরুষ (লাশ ও লুটের মাল বহনের জন্য ব্যবহার)
দ্বিতীয় গ্রুপ: শিশু-কিশোর (বিলের পাড়ে আটকে রাখা হয়)
তৃতীয় গ্রুপ: নারী ও দুগ্ধপোষ্য শিশু (মাদ্রাসা মাঠে নির্যাতনের শিকার)
২. নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন
১৮ জন নারীকে মাদ্রাসা মাঠে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রহিমা খাতুন (একমাত্র জীবিত সাক্ষী) জানান-
“গুলির আগে তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কি পানি খাবে?’ আমরা বললাম, না, তোমরা কাফের, তোমাদের পানি খাব না।”
নিহত নারীদের কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়; কারো মাথা, কারো হাত বিচ্ছিন্ন।
৩. শিশু-কিশোরদের উপর মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন
শিশুদের বলপূর্বক মায়েদের রান্নার কথা শুনিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তারা ফিরে দেখে মায়েদের রক্তাক্ত লাশ।
৪. লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ
স্থানীয় রাজাকাররা ৫০-৬০টি বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়।
ব্যবসায়ীদের গচ্ছিত মালামাল (চাল, সোনা, কাপড়) লুট করা হয়।
৫. হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ
পলায়নরত মানুষদের লক্ষ্য করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও শেলিং করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও শহীদদের তালিকা
আক্রান্ত গ্রামসমূহ
কোদালিয়া, ঈশ্বরদী, ঝাটুরদিয়া, চুড়িয়ার চর, বাগাট, নগরকান্দা বাজার, খাড়দিয়া, কুমারকান্দা, আলমপুরা, বাউসখালী, সোনাতুন্দী, বল্লভদী, রথখেলা, গোপালকরদী, আটকাহনীয়া, বনগ্রাম, গোয়ালদী, মেহেরদিয়া, পুড়াপাড়া, ঘুনাপাড়া, দফা, চাঁদহাট, ঘোনাপাড়া।
কয়েকজন শহীদের নাম
নারী: রহিমুন্নেসা, হামিদা, ফিরোজা বেগম, কলি, ফুলজান বেগম, রাবেয়া খাতুন, নূরজাহান বেগম, সুফিয়া বেগম।
পুরুষ: আফজাল মিয়া, হানিফ মিয়া, গফুর আলী মীর, বাদশা মীর, ফেলু শেখ, আজাহার মোল্লা।
শিশু: পারভীন আক্তার (দুগ্ধপোষ্য), আমেনা বেগমের সন্তান।
গণকবর ও স্মৃতিচিহ্ন
কোদালিয়ায় ২টি গণকবর: মাদ্রাসা মাঠ ও ঈশ্বরদী বিল।
অন্যান্য স্থানে বিচ্ছিন্ন কবর: শহীদদের দ্রুত পুঁতে ফেলা হয়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বর্তমান অবস্থা
এই গণহত্যা ফরিদপুরের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি।
১৯৯৯ সালে রহিমা খাতুন প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমে তার সাক্ষ্য দেন।
আজও শহীদ পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করছে।
কোদালিয়া গণহত্যা শুধু একটি নৃশংস ঘটনা নয়—এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণমানুষের সংগ্রামের স্মারক। এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
সূত্র:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ডকুমেন্টেশন।
স্থানীয় সাক্ষাৎকার (রহিমা খাতুন, ১৯৯৯)।
‘ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ (স্থানীয় ইতিহাস গ্রন্থ)।
মন্তব্য করুন