ঢাকা রবিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৮ কার্তিক ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

উয়ারী-বটেশ্বর: বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৩০ পিএম
০১ মে ২০২৫, ০৫:৫৩ পিএম
উয়ারী-বটেশ্বর

বাংলাদেশের ইতিহাসে উয়ারী-বটেশ্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল, যা প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন বহন করে। নরসিংদী জেলার বেলাবো ও শিবপুর উপজেলায় অবস্থিত উয়ারী ও বটেশ্বর গ্রাম দুটি মিলে এই প্রত্নস্থল গঠিত। এখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ প্রমাণ করে যে, এই অঞ্চলটি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দে গড়ে ওঠা একটি প্রাচীন দুর্গ-নগর ছিল।

আবিষ্কারের ইতিহাস ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে উয়ারী গ্রামে মাটি খননকালে শ্রমিকরা একটি পাত্রে সঞ্চিত রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কার করেন। স্থানীয় শিক্ষক মোহাম্মদ হানিফ পাঠান এই মুদ্রাগুলি সংগ্রহ করে গবেষণা শুরু করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র হাবিবুল্লাহ পাঠান এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বটেশ্বর ও উয়ারী গ্রামে লৌহ নির্মিত অস্ত্র ও রৌপ্যমুদ্রার ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে উয়ারী গ্রামে ব্রোঞ্জের ৩৩টি পাত্র উদ্ধার করা হয়।

প্রফেসর শামসুল আলম এবং তার নেতৃত্বাধীন প্রত্নতাত্ত্বিক দলের ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে পরিচালিত খননকাজে এখানকার গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও নিদর্শন ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে উয়ারী-বটেশ্বরে খননকাজ শুরু হয়। এই খননে প্রাচীন দুর্গ-নগর, পাকা রাস্তা, পোড়ামাটির ফলক, রৌপ্যমুদ্রা, পাথরের গুটিকা, লৌহ কুঠার ও বল্লমসহ বিভিন্ন প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে এখানে ১৮ মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত ও ৩০ সেন্টিমিটার পুরু একটি প্রাচীন পাকা রাস্তা আবিষ্কৃত হয়। প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে:

ব্রোঞ্জ ও তামার অলঙ্কার।

মাটির তৈরি খেলনা ও সরঞ্জাম।

প্রাচীন কৌমারিক মৃৎপাত্র।

লৌহ যুগের অস্ত্র ও সরঞ্জাম।

বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে উয়ারী-বটেশ্বর গবেষকদের মতে, উয়ারী-বটেশ্বর ছিল এককালে গাঙ্গেয় উপত্যকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র।

এর ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করতে সহায়তা করেছিল।

গ্রিক ও রোমান যুগে এই অঞ্চলটি অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সমুদ্রপথে সংযুক্ত ছিল।

টলেমির মানচিত্রে উল্লেখিত 'সৌনাগড়া' নামটি উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র 'ঐতিহ্য অন্বেষণ'-এর উদ্যোগে উয়ারী প্রত্নতাত্ত্বিক গ্রামে 'উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ নগর উন্মুক্ত জাদুঘর' উদ্বোধন করা হয়। এখানে প্রদর্শিত বিভিন্ন নিদর্শন দর্শনার্থীদের প্রাচীন ইতিহাসের প্রতি আকৃষ্ট করে।

প্রাচীন দুর্গ নগরের স্থাপত্য উয়ারী-বটেশ্বরের দুর্গ নগরের স্থাপত্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বহন করে। এর চারপাশে প্রতিরক্ষা দেয়াল, খাল ও নদীর মাধ্যমে বেষ্টিত ছিল, যা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করত।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সংরক্ষণ উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উয়ারী-বটেশ্বরের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে কাজ করছে।

স্থায়ী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পুনরুদ্ধার ও গবেষণা।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে উন্নয়ন।

উয়ারী-বটেশ্বর আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল দিক। এর সংরক্ষণ এবং প্রচার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

তথ্যসূত্র

উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া।

যায়যায়দিন, কালের কণ্ঠ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দল।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১০

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১১

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১২

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৩

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৪

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

১৫

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভিয়েতনামের সমর্থন

১৬

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

১৭

ত্রিমোহনী গণহত্যা ও বধ্যভূমি, নেত্রকোনা

১৮

২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক

১৯

চিংড়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

২০