

মুন্সী আব্দুর রউফ, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, তাঁর জীবন কেবল একটি বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধজয়ের কাহিনি নয়, বরং এটি একটি সংগ্রামী জীবনের দৃষ্টান্ত। নিজের জীবনের বিনিময়ে সহযোদ্ধাদের রক্ষা করে তিনি অমর হয়ে রয়েছেন।
জন্ম ও শৈশব মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের ১ মে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মুন্সী মেহেরউদ্দিন ছিলেন একজন কৃষক। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সাহসী। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। তবে পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার কারণে পড়াশোনা বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেননি।
সামরিক জীবন ১৯৬৩ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে মুন্সী আব্দুর রউফ তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ যোগ দেন। প্রশিক্ষণকালেই তিনি সাহসিকতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। তাঁকে বিশেষ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেখানে তিনি প্যারাট্রুপার প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও বীরত্বগাথা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুন্সী আব্দুর রউফ ইপিআরের একজন ল্যান্স নায়েক হিসেবে খাগড়াছড়ি সেক্টরে মোতায়েন ছিলেন। ২০ এপ্রিল মহালছড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে তিনি বীরত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন।
পাকিস্তানি বাহিনী স্টিমার ও স্পিডবোটে করে কাপ্তাই লেকের জলপথ দিয়ে আক্রমণ চালায়। গোলাবারুদের তীব্র বৃষ্টির মধ্যেও মুন্সী আব্দুর রউফ তাঁর মেশিনগান দিয়ে শত্রুপক্ষকে ভয়াবহ ক্ষতি করেন। তাঁর সাহসিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে নিরাপদে অবস্থান নিতে সক্ষম হন। তবে তিনি নিজে শত্রুর মর্টার শেলিংয়ের আঘাতে শহীদ হন। তাঁর আত্মত্যাগে অসংখ্য সহযোদ্ধার প্রাণ রক্ষা পায়।
বীরত্বের স্বীকৃতি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার মুন্সী আব্দুর রউফকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হয় নানা স্মৃতিসৌধ ও প্রতিষ্ঠান। ফরিদপুরের সালামতপুর গ্রামে তাঁর সমাধি ও স্মৃতিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য প্রতীক হয়ে আছে।
ব্যক্তিগত জীবন মুন্সী আব্দুর রউফ ছিলেন একজন সৎ, বিনয়ী ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ। পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ ছিল গভীর। যদিও তিনি বিবাহিত ছিলেন না, তবুও পরিবারের জন্য তিনি ছিলেন প্রধান আশ্রয়।
প্রেরণার উৎস মুন্সী আব্দুর রউফের জীবন ও বীরত্ব প্রতিটি বাংলাদেশির জন্য প্রেরণার উৎস। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তি শক্তিশালী করেছে। আজও তিনি বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে, একজন অনন্ত সাহসী যোদ্ধা হিসেবে।
"মৃত্যু নয়, বীরত্বই চিরন্তন।"
মন্তব্য করুন