মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত প্রচেষ্টা এবং অগণিত ঘটনার সমাহার। এই দিনে খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে বহু সহযোদ্ধার জীবন রক্ষা করেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ।
খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা ও রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত কাপ্তাই লেক ছিল তখন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। কাপ্তাই-রাঙামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি-জালিয়াপাড়া হয়ে রামগড়ে যাওয়ার এই জলপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেজর মীর শওকত আলীর (পরে বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী) নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সেনা সমন্বয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই জলপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে। ২০ এপ্রিল দুপুরে তাদের একটি বড় দল স্টিমার ও স্পিডবোটে করে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে তীব্র হামলা চালায়। স্টিমার থেকে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। ইপিআরের ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ অসম সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি হয়ে মেশিনগান চালাতে থাকেন। তাঁর নির্ভীক প্রতিরোধের ফলে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানসহ মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। পাকিস্তানি সেনাদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে যুদ্ধ করতে করতে মুন্সী আব্দুর রউফ শহীদ হন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে।
শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান
মুন্সী আব্দুর রউফের শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান নিয়ে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থানে এই তারিখ কোথাও ৮, কোথাও ১৮ এপ্রিল বলা হয়েছে। তবে ১৯৭১ সালে মুন্সী আব্দুর রউফকে নিয়ে লেখা মুজিবনগর সরকারের অভিজ্ঞানপত্রে তাঁর শহীদ হওয়ার তারিখ ২০ এপ্রিল উল্লেখ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, মীর শওকত আলী এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের স্বাক্ষরিত এ অভিজ্ঞানপত্রে তাঁর নামের বানান ভুলভাবে ‘মুন্সী আবদুর রব’ লেখা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সংশোধন করা হয়।
চৌধুরী খালেকুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “২০ এপ্রিল মহালছড়ির বাঘমারা নামক একটি পাহাড়ি এলাকায় আমরা অবস্থান গ্রহণ করি। দুপুর ১২টার সময় পাকিস্তানি পতাকাবাহী একটি স্টিমার, কয়েকটি স্পিডবোট এবং নৌকায় সামরিক ও বেসামরিক লোক দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতিহত করার জন্য তৈরি হই। যুদ্ধের জন্য এলাকাটি মোটেও অনুকূল ছিল না।... মুন্সী আবদুর রউফ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। তাঁর গুলিবর্ষণে শত্রুপক্ষের ভীষণ ক্ষতি হয়।... তাঁদের মর্টার শেলিংয়ে মুন্সী আব্দুর রউফ শহীদ হন। আমি তাঁর সাইটেশন লিখি।”
মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য ঘটনা
এই দিনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব’ শিরোনামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর জন ও পেস্টর বাঙালিদের ওপর অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করে একটি চিঠি লেখেন।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এই দিনে আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ কয়েকজনকে ২৬ এপ্রিল সকালে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
উত্তরবঙ্গের হিলি ও মিরসরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের তীব্র যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে সরে যান।
সূত্র: ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস’, ‘সামরিক জীবনের স্মৃতি: ১৯৬৪–19৮১’, দৈনিক পাকিস্তান (২১ এপ্রিল ১৯৭১)।
মন্তব্য করুন