লামিয়া মোর্শেদ, খলিলুর রহমান, আশিক চৌধুরী, ল্যুফি চৌধুরী, আলী ইমাম, তৈয়ব, ইবাদ, আরার—ইত্যাদি সবাইকে কি আপনারা চেনেন? এরাই কিন্তু এখন দেশ চালাচ্ছেন!
প্রধান উপদেষ্টা কখনও উপদেষ্টা, আবার কখনও হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ কিংবা বিশেষ সহকারী নিয়োগ করছেন। পরে তারাই আবার উপদেষ্টা হয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান হঠাৎ করেই নিরাপত্তা উপদেষ্টা হয়ে গেলেন। তিনি পুরোদস্তুর আমেরিকান নাগরিক। কালেভদ্রে বাংলাদেশে আসেন।
২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমানের বিশেষ সহযোগী হিসাবে এসেছিলেন। ভায়রা হিসাবে যুগ্ম সচিবের পদ মর্যাদাও পেয়েছিলেন। তিন মাসের মধ্যেই পরকীয়া, ফলস্বরূপ জোড়া খুন এবং প্রস্থান।
এদের কারো সম্পর্কেই আমরা বিশেষ কিছু জানি না। তারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে দারুণ চৌকস ব্যক্তিত্ব। যেহেতু তাদের প্রায় সবাই বিভিন্ন দেশে থাকেন, আমাদের জানারও কোনো উপায় নেই।
ইদানীং তাদের ঘনিষ্ঠজন ও পরিচিতজনই তাদের তুলে ধরছেন ফেসবুক, লিংকডইন এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে। আমরা তাদের ভাষ্যেই এই গুণীজনদের আমলনামা তুলে ধরবো আগামী সপ্তাহগুলোতে।
সবাই যেন জিতে গেল!
৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর তো মনে হয়েছিল বিএনপি ক্ষমতায় এসেই গেছে—শুধু চেয়ারে বসা বাকি। জামায়াতে ইসলামি তো প্রশাসন, ব্যাঙ্ক, মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয় সব দখল করে নিল। এমনকি ছোট ছোট বাম দল মান্না, জুনায়েদ সাকি সাহেবরাও ক্ষমতার কাছাকাছি।
যদিও মূলত এনজিও আর চট্টগ্রাম নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলো। তাই সবাই একে “এনজিওগ্রাম সরকার” হিসেবেই অভিহিত করলেন। তবে বোঝা গেল, নিয়ন্ত্রণ থাকবে একজনেরই। চমৎকার বাচনভঙ্গিতে বিশ্বব্যাপী পরিচিত প্রধান উপদেষ্টাই থাকবেন পুরো নিয়ন্ত্রণে। বেফাঁস কিছু বলা যাবে না, বেফাঁস কিছু করা যাবে না।
দুই দিনের মাথায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা একটা বেফাঁস কথা বলায় মুহূর্তেই তাকে পাট ক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিলেন—মানে পাট উপদেষ্টা বানিয়ে দিলেন।
গ্রামীণ পরিবার আর নিজ পরিবার থেকেই খুব বেশি কাউকে নিলেন না। সহকর্মী নূরজাহান বেগম, ফারুক-ই-আজম, স্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বিধান রঞ্জন, আর ছোট ভাইয়ের ছেলে অপূর্ব জাহাঙ্গীর। এক সময় পরে নিয়ে এলেন ইউনুস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোর্শেদকে।
শুরু হচ্ছে কোম্পানির শাসন?
শুরুতেই যাদের নাম বললাম, তারা কেউ না কেউ ইউনুস সেন্টারের সাথে যুক্ত। ইউনুস সেন্টার কী? সবাই জানেন?
সারা বিশ্বে ইউনুস সেন্টারের শাখা (সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার—এসবিসি) আছে ১০৯টি। নোবেল প্রাইজ, ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড, প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড, গেটস ফাউন্ডেশনের অনুদান, জর্জ সরোসের সাথে সম্পর্ক, ইলন মাস্কের সাথে দরদ—এসব নিয়েই তো এদের কর্মকাণ্ড।
এই সেন্টারের প্রধান কাজ হলো প্রফেসর ইউনুসের কর্মকাণ্ড ও তাঁকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। তাদের নেটওয়ার্ক ও ক্যাম্পেইন মেকানিজম দুর্দান্ত।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, বিনিয়োগকারী ছুটে আসছেন দেশকে বাঁচানোর জন্য। তাদের নেটওয়ার্ক এতই শক্তিশালী যে এক সপ্তাহেই সারা দুনিয়ায় আওয়াজ উঠেছে—বাংলাদেশের জনগণ নাকি তাঁকেই পাঁচ বছরের জন্য চায়। তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়। এমন রাষ্ট্রনায়ক নাকি বাংলাদেশে আর কখনও আসেনি। উনিই হতে পারেন আধুনিক বাংলাদেশের রক্ষাকর্তা। মুখে মুখে এখন এই কথা।
শুধু তা-ই নয়, নানা ভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা মহল থেকে তাকেই আজীবনের প্রধানমন্ত্রী করার দাবি-আবদারও আসছে। কিছুদিন পর হয়তো বিদেশি নেতারাও বলা শুরু করবেন।
এবারের স্ক্রিপ্ট বড় পোক্ত স্ক্রিপ্ট!
ইউনুস সেন্টার প্রচারে, ব্র্যান্ডিংয়ে সিদ্ধহস্ত। তাদের স্ক্রিপ্ট আনিসুল হক-সালমান এফ. রহমানের গ্রেপ্তারের মতো কাঁচা স্ক্রিপ্ট হবে না। ওদের স্ক্রিপ্ট হবে আরও পরিমিত, বিশ্বাসযোগ্য, সুদূরপ্রসারী।
ইতিমধ্যেই এক ইনভেস্টমেন্ট সামিট করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। আশিক চৌধুরীর স্মার্ট প্রেজেন্টেশন নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ নিয়ে কান্নার অভিনয়টাও ভালোই করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। অথচ যেখানে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনসহ বিশ্বের তাবৎ অর্থনীতিবিদরা বলেছেন ওটা ছিল “ম্যান-মেইড ফ্যামিন”—সেখানে তিনি কীভাবে “আমাদের জাতি এক ফসলি, কৃষকরা অদক্ষ, দরিদ্র” ইত্যাদি বলে চোখের পানি ফেললেন?
হ্যাঁ, দরিদ্রতাকেই ঘিরে তাঁর ব্যবসা। সারা বিশ্বে দারিদ্র্য বেচেই গড়ে উঠেছে এই সাম্রাজ্য।
কিন্তু এখনকার দুনিয়ায় কি সেটা চলবে? এখন তো লড়াই সামর্থ্য আর সক্ষমতার। সে কারণেই গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহীকে সিঙ্গাপুর থেকে উড়িয়ে এনে বিডা, বেজার কর্ণধার করা হয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট সামিটের প্রেজেন্টেশন চমৎকার ছিল, টেডটকের স্পিকার, ভালো হবেই। কিন্তু উনি কি উল্লেখ করেছেন—বিডা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর, বেজা (বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১০ সালের নভেম্বরে, এবং হাইটেক পার্কও ২০১০ সালে। উনি তো এসব জায়গাতেই বিনিয়োগের কথা বলেছেন।
স্মার্ট প্রেজেন্টার কিউআর কোড দিয়ে ওনার প্রেজেন্টেশন পাবলিক ডোমেইনে দিচ্ছেন। কিন্তু মূল স্লাইডে যেসব পোর্ট—মাতারবাড়ি, পায়রা, মংলা, নিউ মুরিং, লালদিয়া—সবগুলোতেই তো অনেক আগেই স্বাক্ষর হয়েছে। অনেকগুলোর অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে। কোরিয়ার ইয়ং ওয়ান প্রতিষ্ঠিত ইপিজেড তো ১৯৮০ সাল থেকেই চলছে। ওদের কারণেই তো কর্ণফুলী টানেল হলো। এখন পর্যন্ত শতাধিক কোম্পানি সেখানে স্থাপিত। এটা নিয়ে বর্তমান সরকারের কি কোনো কৃতিত্ব নেই?
আর দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড তো চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে নিউ মুরিং ও বে টার্মিনালে আগেই চুক্তিবদ্ধ। তাহলে নতুন কী হলো এই বিনিয়োগ সামিটে?
উপস্থাপনা চমৎকার হয়েছে, কিন্তু কনটেন্ট খুবই দুর্বল। আগামী সপ্তাহে ২০২১ ও এবারের ইনভেস্টমেন্ট সামিটের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরবো।
এবারেও দুর্বল স্ক্রিপ্ট???
সামিটের প্রথম দিনেই বাটা আর পিজ্জা হাট লুট হয়ে গেল?
এরপরও কি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নেচে নেচে চলে আসবেন?
চমক দেখিয়ে তো বিনিয়োগকারীদের আনা যাবে না। এর জন্য অনেকগুলো নীতিগত পরিবর্তন দরকার। সেটা কোনো সরকারই করছে না। ফলে প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।
এবার হয়তো সম্ভব হবে!
আগেই বলেছি—এখন আসছে কোম্পানি শাসন। এরাই কি নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি?
সব মূল জায়গায় প্রতিমন্ত্রী/মন্ত্রী মর্যাদার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ। এরা সবাই গ্রামীণ পরিবার/ইউনুস সেন্টার/ইউনুস কোম্পানির এক সময়কার সদস্য। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন বিশ্বজুড়ে। এখন দেশ সেবায় এসেছেন।
ছাত্রদের দিয়ে দিয়েছেন মব সন্ত্রাস, পদায়ন, বদলি, জামিন ইত্যাদি কাজে। বিএনপিকে বোঝানো হচ্ছে—“আপনারা তো আছেনই। দল গোছান, চাঁদা তুলুন, দখল নিন।” জামায়াতের আমির সাহেব তো আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে ঠোঁটে, কপালে, হাতে চুমু দিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর তাদের ক্যাডার বাহিনী দখল করছে বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া, প্রশাসনের পদ, গঠন করছে নতুন পুলিশ বাহিনী।
উনি বলেছেন, তিনি হচ্ছেন ডিল মেকার। ট্রাম্পের সাথে ডিল করে ফেলেছেন—ওনারা তো তার তুলনায় নস্যি। সবাইকে কিছু কিছু শেয়ার দিয়ে সারা দুনিয়া সয়লাব করে দিয়েছেন—“নির্বাচনের দরকার নেই, এই মহাজনকে চাই পাঁচ বছর।” এদিকে জরিপ, ঐদিকে মতামত, টক শো—সবখানে শুধু একই আওয়াজ: “উনিই আজীবন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকুন।”
একেই বলে ইউনুস সেন্টার—নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কে হবে লর্ড ক্লাইভ আর কে হবে ওয়ারেন হেস্টিংস, জানা না থাকলেও শুরু হচ্ছে নতুন মোড়কে কোম্পানি শাসন।
মন্তব্য করুন