ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

৩১ আগস্ট ১৯৭১: শ্রীরামসি (ছিরামিসি) গণহত্যা

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
৩১ আগস্ট ২০২৫, ০৭:১৯ পিএম
৩১ আগস্ট ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম
৩১ আগস্ট ১৯৭১: শ্রীরামসি (ছিরামিসি) গণহত্যা

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল একটি ঐতিহাসিক সংগ্রাম, যা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতা, মুক্তিবাহিনীর সাহসী গেরিলা অভিযান এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের মাধ্যমে চিহ্নিত। এই যুদ্ধের একটি কালো অধ্যায় হলো শ্রীরামসি (বিকল্প স্পেলিং: ছিরামিসি) গণহত্যা, যা ৩১ আগস্ট মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায় সংঘটিত হয়। এই দিনটি শুধুমাত্র গণহত্যার জন্য নয়, বরং মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন অভিযান, আন্তর্জাতিক নেতাদের মন্তব্য এবং পাকিস্তানের প্রশাসনিক পরিবর্তনের জন্যও স্মরণীয়।

শ্রীরামসি গণহত্যার পটভূমি এবং ভৌগোলিক গুরুত্ব

সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত শ্রীরামসি গ্রামটি ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের মধ্যস্থলে একটি পুরাতন বাজার, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন শ্রীরামসি হাইস্কুল, পোস্ট অফিস, তহসিল অফিস ইত্যাদি রয়েছে, যা এটিকে একটি পরিচিত এলাকা করে তুলেছে। বিশ্বনাথ থেকে একটি খাল শ্রীরামসি গ্রামের ভেতর দিয়ে জগন্নাথপুর পর্যন্ত প্রবাহিত, যা এর কৌশলগত গুরুত্ব বাড়িয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন, যার ফলে সামরিক অভিযানের সূচনা থেকেই পাকবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকাররা এই গ্রামকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে। ২৯ আগস্ট চিলাউড়া গ্রামের রাজাকার আব্দুল ওয়াতির এবং মছলম উল্যাহ শ্রীরামসি গ্রামে এসে আকর্ষণীয় বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেখিয়ে যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের আহ্বান জানায়। কিন্তু গ্রামের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ তাদের এই আহ্বান ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে এবং তাদের তাড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা পাকবাহিনীর ভয় দেখিয়ে গ্রামবাসীকে শাসিয়ে চলে যায়, যার ফলে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকেই গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এই ঘটনা গণহত্যার পটভূমি তৈরি করে।

গণহত্যার বিস্তারিত বর্ণনা: পাকহানাদার বাহিনীর নির্মমতা

৩১ আগস্ট সকাল ৯-১০টায় পাকহানাদার বাহিনী কিছু রাজাকার এবং আলবদর নিয়ে জগন্নাথপুর থেকে ৮-৯টি নৌকায় করে ছিরামিসি (শ্রীরামসি) বাজারে আসে। রাজাকার এবং আলবদররা গ্রামের সকল মানুষকে শান্তি কমিটির মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়। শান্তিপ্রিয় গ্রামের মানুষ শান্তির আকাঙ্ক্ষায় ছিরামিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে জমায়েত হয়। যারা আসতে দেরি করে, তাদের ডেকে আনা হয়। আগত সবাই স্কুলের হল রুমে আলোচনা আরম্ভ করার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, এমন সময় বর্বররা শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী এবং যুবকদের আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে পেছন দিক দিয়ে হাতগুলো বেঁধে দেয়। পরে ১৫-১৬ জনের একেকটি দল করে এক সঙ্গে বেঁধে নৌকায় নিয়ে নির্বিবাদে গুলি চালায়। কোনো কোনো দলকে নিকটবর্তী পুকুরপাড়ে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পানিতে পড়ে বাঁচার চেষ্টা চালালে পুকুরপাড় থেকে পাক বর্বররা এলোপাতাড়ি গুলি করে। এভাবে পাক জল্লাদরা ছিরামিসি গ্রামের ১২৬ জন নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে।

পাকবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে কুখ্যাত রাজাকার আহমদ আলী (হাবিবপুর), আছাব আলী (হাবিবপুর) এবং জানু মিয়া (খাদিমপুর, বালাগঞ্জ)। তারা শ্রীরামসি গ্রামবাসীদের শ্রীরামসি হাইস্কুল মাঠে শান্তি কমিটির সভায় যোগদানের কথা বলে ধরে নিয়ে আসে। তারপর তাদের মধ্য থেকে যুবক এবং বয়স্কদের আলাদা করে স্কুলের দুটি কক্ষে আটকে বেঁধে ফেলে। সেখানে তাদের ওপর নির্যাতনের পর যুবকদের নৌকায় করে শ্রীরামসির রহিম উল্যাহর বাড়িতে এবং বয়স্কদের নজির মিয়ার বাড়ির পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়। তারপর তাদের সবাইকে হাত বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায়। এ সময় রহিম উল্যাহর বাড়িতে লাইনে দাঁড়ানো পাঁচজন পাকবাহিনীর সমর্থক দাবি করে প্রাণভিক্ষা চায়। স্থানীয় এক রাজাকার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাদের পাঁচ জনকে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ করলে শ্রীরামসি বাজার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার শর্তে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তারা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। এদিন পালিয়ে বেঁচে যান শ্রীরামসি গ্রামের হুসিয়ার আলী, ডা. আবদুল লতিফ, জওয়াহিদ চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণের সময় কয়েকজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের মৃত ভেবে হানাদাররা চলে যায়। তারা হলেন- আবদুল লতিফ (শ্রীরামসি পোস্ট অফিসের নৈশ প্রহরী), জোয়াহির চৌধুরী (গদাভাট), ছকিল উদ্দিন (দিঘীরপাড়), তপন চক্রবর্তী (নিহত তহসিলদার সত্যেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর আত্মীয়), আমজাদ আলী, ইলিয়াছ আলী, এলকাছ আলী এবং সুন্দর আলী।

এই গণহত্যায় শহীদদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন- ছাদ উদ্দিন আহমদ (শ্রীরামসি হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক), মওলানা আবদুল হাই (শ্রীরামসি হাইস্কুলের হেড মওলানা), সত্যেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী (তহসিলদার), এহিয়া চৌধুরী (তহসিলদার), সৈয়দ আশরাফ হোসেন (পোস্ট মাস্টার), আবদুল বারী (মীরপুর ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার), ফিরোজ মিয়া (কাদিপুর), এখলাসুর রহমান (দিঘীরপাড়), সামছু মিয়া (সাতহাল), আবদুল লতিফ (সাতহাল), ওয়ারিছ মিয়া (সাতহাল), আলী মিয়া (সাতহাল), ছুয়ার মিয়া (সাতহাল), আবদুল লতিফ-২ (সাতহাল), রইছ উল্যাহ (সাতহাল), মানিক মিয়া (সাতহাল), দবির মিয়া (আব্দুল্লাহপুর), মরম উল্যাহ (গদাভাট), মমতাজ আলী (রসুলপুর), আবদুল মজিদ (রসুলপুর), নজির মিয়া (রসুলপুর), সুনু মিয়া (রসুলপুর), ডা. আবদুল মান্নান (শ্রীরামসি বাজার), ছামির আলী (পশ্চিম শ্রীরামসি), রুপু মিয়া (শ্রীরামসি), আছাব মিয়া (শ্রীরামসি), রুস্তম আলী (শ্রীরামসি), তৈয়ব আলী (শ্রীরামসি), রোয়াব আলী (শ্রীরামসি), তোফাজ্জল আলী (শ্রীরামসি), মছদ্দর আলী (শ্রীরামসি), আবদুল মান্নান (হাবিবপুর), নূর মিয়া, জহুর আলী, শফিকুর রহমান, সমুজ মিয়া, বাক্কু মিয়া এবং মোক্তার মিয়া। এতে রাজাকারদের সহযোগিতায় শতাধিক মানুষ পাকহানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার শিকার হন, যার মধ্যে ৩৮ জনের নাম পাওয়া গেছে।

হত্যাযজ্ঞের পর শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ। ছিরামিসি বাজারের ২৫০টি দোকান কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে পাক হানাদাররা। সেখান থেকে হানাদাররা জনশূন্য গ্রামে গিয়ে লুটতরাজ চালায় এবং ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তারা শ্রীরামসি বাজারটি লুণ্ঠন শেষে বাজারের দোকানগুলোতে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। লুটপাটের পর শ্রীরামসি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। বেশ কয়েকজন নারীকে তারা নৌকায় তুলে নিয়ে যায়, যাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এভাবে এক বিরানভূমিতে পরিণত হয় ঐতিহ্যবাহী শ্রীরামসি গ্রাম।

গণহত্যার স্মৃতিচিহ্ন এবং স্মারক

গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু খালেদ চৌধুরীর সহযোগিতায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। শ্রীরামসি গ্রামের রহিম উল্যাহর বাড়িতে যেখানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সে বাড়িটিতে (বর্তমানে বিশ্বনাথ উপজেলার অন্তর্গত) সিরাজ উদ্দিন মাস্টারের নকশায় একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। নজির মিয়ার বাড়িতে সংঘটিত গণহত্যার স্থানটি দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্মারকগুলো যুদ্ধের নির্মমতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে শিক্ষা দেয়।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১০ম খণ্ড; [শফিউদ্দিন তালুকদার]; দৈনিক যুগান্তর; দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড; মান্থলি কনটেম্পোরারি; দ্য সানডে টেলিগ্রাফ; ডেইলি টেলিগ্রাফ।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০