ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২৮ আগস্ট ১৯৭১: পাকুড়িয়া গণহত্যা (মান্দা, নওগাঁ)

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৫৩ পিএম
২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৮:১৭ পিএম
২৮ আগস্ট ১৯৭১: পাকুড়িয়া গণহত্যা (মান্দা, নওগাঁ)

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের দ্বারা অসংখ্য গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, যা জাতির ইতিহাসে চিরকালীন কলঙ্ক হিসেবে অঙ্কিত। এরকম একটি বর্বর ঘটনা ঘটে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামে। এই গণহত্যা সংঘটিত হয় ২৮ আগস্ট ১৯৭১ সালে, যা পাকুড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত। এতে ১২৮ জন নিরীহ গ্রামবাসী—নারী-পুরুষ নির্বিশেষে—নির্মমভাবে নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের পর পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের বহু বাড়িঘর লুটপাট করে, অগ্নিসংযোগ করে এবং নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়, যা গ্রামটিকে একটি বিধ্বস্ত এবং বিধবা-পল্লীতে পরিণত করে। এই ঘটনা নওগাঁ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত নির্মম এবং পৈশাচিক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।

ঘটনার পটভূমি এবং ক্রমানুসার বর্ণনা

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন কৌশলে নিরীহ মানুষকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করত। পাকুড়িয়া গণহত্যার ক্ষেত্রেও একই কৌশল অবলম্বন করা হয়। ২৪ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ২৮ আগস্ট পাকুড়িয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে (বর্তমানে শহীদ বাজার নামে পরিচিত) একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। এলাকার সকল মোড়ল (গ্রামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি) এই সভায় উপস্থিত থাকবেন বলে নির্দেশ দেওয়া হয়, এবং সাধারণ গ্রামবাসীদেরও উপস্থিত থাকার আহ্বান জানানো হয়। এটি ছিল একটি ছলনাময় ফাঁদ, যার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামবাসীদের এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে হত্যা করা।

২৮ আগস্টের কাকডাকা ভোরে, নওগাঁ ক্যাম্প থেকে আনুমানিক ১০০ জন পাকিস্তানি হানাদার সেনা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকুড়িয়া গ্রামের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তারা গ্রামের যুবক, বয়স্ক এবং নিরীহ মানুষদের ধরে এনে বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো করে। সভায় সাধারণ মানুষের সামান্য উপস্থিতি দেখে পাকিস্তানি সেনারা ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং রাজাকারদের সাহায্যে গ্রাম ঘিরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষকে আটক করে মাঠে নিয়ে আসে। আটককৃতদের ওপর প্রথমে নির্যাতন চালানো হয়, তারপর কমান্ডারের নির্দেশে তাদের হাঁটু গেড়ে লাইনে বসিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করে নারীদের ওপর নির্যাতন, লুটতরাজ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে।

এরপর শুরু হয় দফায় দফায় গুলিবর্ষণ। মেশিনগান, স্টেনগান এবং ব্রাশ ফায়ার দিয়ে উপস্থিত গ্রামবাসীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বেয়নেট দিয়ে দেহ খুঁচিয়ে দেখা হয়। সকাল থেকে শুরু হয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা এই হত্যাকাণ্ডে ১২৮ জন নারী-পুরুষ প্রাণ হারান। এর মধ্যে একই পরিবারের বাবা, চাচা, দাদাসহ ৭ জন নিহত হন। হানাদার বাহিনী গ্রাম ত্যাগ করার পর বুলেটবিদ্ধ ও মারাত্মকভাবে আহত ১৯ জনকে উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তী দিনগুলোয় মারা যান। এই গণহত্যা গ্রামটিকে একটি রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত করে, এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নির্মম গণহত্যা হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।

শহিদদের তালিকা

পাকুড়িয়া গণহত্যায় শহিদ ১২৮ জনের মধ্যে ৭৩ জনের নাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তারা হলেন:

  • নহির উদ্দিন প্রামাণিক
  • সাবির উদ্দিন সরদার
  • বয়েজ উদ্দিন মণ্ডল
  • জেককার আলী মণ্ডল
  • মোসলেম আলী মণ্ডল
  • ইসমাইল হোসেন প্রামাণিক
  • পিয়ার বক্স প্রামাণিক
  • নাজিম উদ্দিন
  • মহির সরদার
  • আববাছ আলী সরদার
  • ফজের চৌকিদার
  • কেমতুল্ল্যা
  • মঞ্জিলা সরদার
  • বিনোদ আলী শাহ
  • মকবুল হোসেন শাহ
  • নজরুল ইসলাম শাহ
  • ঝড়ু মণ্ডল
  • পবন মণ্ডল
  • লহির মোল্যা
  • আবেদ আলী মোল্যা
  • সুরুজ আলী মণ্ডল
  • বাছের আলী সরদার
  • ইমান আলী মোল্যা
  • আব্দুর রহমান পাইক
  • হযরত আলী মোল্যা
  • তঞ্জের আলী মোল্যা
  • মহির উদ্দিন মোল্যা
  • মছের আলী সুতার
  • মোবারক আলী প্রামাণিক
  • আরব আলী প্রামাণিক
  • তালেব আলী প্রামাণিক
  • বারু মোল্যা
  • জমির আলি মোল্যা
  • চৈতা মোল্যা
  • ছবের আলী মোল্যা
  • ইনাত আলী করাতী
  • পিয়ার বক্স মণ্ডল
  • বাদলা মণ্ডল
  • কদম মোল্যা
  • অদল মোল্যা
  • বজের মোল্লা
  • বশরতুল্লা প্রামাণিক
  • মজিবর রহমান প্রামাণিক
  • ইসমাইল হোসেন প্রামাণিক
  • ফারাজ আলী প্রামাণিক
  • দশো মোল্যা
  • নেপুর মোল্যা
  • তছির মোল্যা
  • খোদাবক্স প্রামাণিক
  • মাদারবক্স মোল্যা
  • ভাদু মোল্যা
  • হাফিজ উদ্দিন মোল্যা
  • তালেব আলী মোল্যা
  • লবির দেওয়ান
  • তমিজউদ্দিন দেওয়ান
  • লজের আলী
  • লোকমান আলী
  • হাফেজ আলী মোল্যা
  • বজের পাথর
  • প্রফুল দেওয়ান
  • আব্দুল হামিদ
  • ওসমান আলী
  • নুর উদ্দিন
  • মোসলেম উদ্দীন
  • মাহতাব আলী
  • বদু শাহ
  • বুলন বেওয়া ওরফে পুড়া
  • কুড়ানু মোল্যা
  • মছির প্রামাণিক
  • বিরাজ মণ্ডল
  • ইয়াদ আলী করাতী
  • খছের আলী
  • লজের আলী শাহ

এদের সকলকে পাকুড়িয়ায় গণকবর দেওয়া হয়। গণকবরের স্থানটি রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের মাঝামাঝি দেলুয়া বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।

আহতদের তালিকা

পাকুড়িয়া গণহত্যার সময় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বেঁচে যান ১৯ জন, যাদের অনেকে পরবর্তীতে চিকিত্সার অভাবে বা আঘাতের তীব্রতায় মারা যান। আহত ব্যক্তিরা হলেন-

  • মো. শমসের প্রামাণিক
  • হেদায়েতুল্লাহ
  • মমতাজ উদ্দীন
  • ছাবেদ আলী
  • জোনাব আলী
  • হাছেন আলী
  • আশরাফুল ইসলাম
  • আফসার আলী
  • আফজাল হোসেন
  • আজিজুর রহমান
  • ইমান আলী
  • ইনায়েত আলী
  • মেরুল্ল্যা শাহ
  • আকন্দি
  • কছের
  • নসরতুল্লা মিঞা
  • মহবতুল্ল্যা
  • গাবু পাথর
  • নাসের আলী

এই আহতরা মরার ভান করে বেঁচে যান, কিন্তু তাদের অনেকের জীবন চিরকালের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সংরক্ষণ এবং স্মৃতি

স্বাধীনতার পর পাকুড়িয়া গণহত্যার স্থানটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখানে একটি নামফলক নির্মিত হয়েছে, যার দেয়ালে শ্বেতপাথরে শহীদ এবং আহতদের নামের তালিকা খোদাই করা রয়েছে। বাজারের নাম পরিবর্তন করে 'শহীদ বাজার' রাখা হয়েছে, এবং স্থানটি নিচু ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। একটি সুদৃশ্য ফটকও নির্মিত হয়েছে, যা এই বধ্যভূমিকে স্মৃতিরক্ষার প্রতীক করে। প্রতি বছর ২৮ আগস্ট এই দিবস পালন করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে, যাতে শহীদদের স্মরণ করা হয়। সূত্র:

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৫ম খণ্ড

মফিউদ্দিন আহমদ

চিত্তরঞ্জন মিশ্র

মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০