বাংলা ভাষার ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষা ছিল অবহেলিত। সে সময় রাজকীয় ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ভাষাকেই প্রাধান্য দেয়া হতো। পাল রাজবংশের খালিমপুর তাম্রলিপি থেকে বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তির মতো প্রায় সব লিপিমালা লেখা হতো সংস্কৃত ভাষায়। যদিও পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধ গান ও দোহাগুলো ছিল বাংলা ভাষার নিদর্শন। সেন রাজাদের শাসনামলে সংস্কৃতকে দেবভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়। সংস্কৃত ভাষাই হয়ে ওঠে অন্যতম ভাষা। সেন যুগের কবি সাহিত্যিকরা সংস্কৃত ভাষায়ই লিখতে থাকেন রাজ প্রশস্তি এমনকি বিখ্যাত সব গীতিকাব্য। সংস্কৃত ভাষার কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ধোয়ী, জয়দেব, গোবর্ধন, শরণ ও উমাপতিধর। সুভাষিত রত্নকোষ, সদুক্তিকর্ণামৃতের মতো সংকলিত গ্রন্থগুলোও পণ্ডিতেরা রচনা করেছেন সংস্কৃত ভাষায়। প্রাচীনকালে বা প্রাক-মুসলিম যুগে বাংলা ভাষার কবি ছিল না, এমন নয়। কিন্তু তারা ছিলেন অবহেলিত। বাংলা চর্যাপদের প্রতিও এ ধরনের উদাসীনতা লক্ষ করা যায়।
ড. ওয়াকিল আহমদ যথার্থই মনে করেন, ‘মুসলমান ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বাংলা ভাষার কবিগণ কোন হিন্দুরাজার কাছ থেকে সহযোগিতা বা দাক্ষিণ্য পাননি; আমরা এজন্য দায়ী করেছি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের। বৌদ্ধ পাল রাজাদের নৈতিক উদারতা ছিল, তাদের সুশাসনে বাঙ্গালীর সাংস্কৃতিক জীবনে ‘‘স্বর্ণযুগের’’ সঞ্চয় সমাহৃত হয়েছিল। বাংলা চর্যাপদের জন্ম তখনই। সেন বংশের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর (দ্বাদশ শতাব্দীতে) ব্রাহ্মণ্যবাদ অকারণ রুষ্ট হয়ে উঠল এবং বাঙ্গালী বৌদ্ধ নিধন-পর্ব কেবল সমাপ্ত হল না, তাদের কৃষ্টিকেও নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চলল। বৌদ্ধরা সেদিন নেপালে পালিয়ে গিয়ে এরূপ ধ্বংসযজ্ঞ হতে চর্যাপদের অবলুপ্তি রোধ করেছিল।’
অবহেলিত বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হয় মুসলিম শাসনামলে। এটা সম্ভব হয়েছিল শাহ ই বাঙ্গালার মাধ্যমে সুলতানি আমলের মুসলমান শাসকরা বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চল ও অধিবাসীদের একত্রীকরণ করে একটি রাজনৈতিক ভাষাভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে। ইতিহাসবিদ ড. আব্দুর রহিম বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রথম খণ্ডে বাংলা ভাষার উন্নতির বিবরণ দিতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, এই প্রদেশে মুসলমান শাসন প্রবর্তিত না হলে বাংলা ও বাঙালি নাম দুটো ইতিহাসের স্থান লাভ করত কিনা সন্দেহ। তিনি আরো বলেছেন, প্রাচীনকালে এদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির একমাত্র বাহন ছিল সংস্কৃত। এই সময়ে বাংলা ছিল উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা।
সুলতানি আমলের শাসকদের মধ্যে সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪১০ খ্রি.), সুলতান জালাল উদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৫-১৪১৬ খ্রি. ও ১৪১৮-১৪৩৩ খ্রি.), সুলতান শামসউদ্দীন আহমদ শাহ (১৪৩৩-১৪৩৫ খ্রি.), সুলতান রুকন উদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.), সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রি.), সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) প্রমুখদের পৃষ্ঠপোষকতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গণমুখী হয়ে ওঠে। ফলে সুলতানি ও মোগল আমল হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের পণ্ডিত গবেষক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনও সেটাই মনে করেন। তার মতে, ‘মুসলমানেরা ইরান, তুরান প্রভৃতি যে স্থান থেকেই আসুন না কেন এদেশে এসে তাঁরা সম্পূর্ণ বাঙালী হয়ে পড়েন এবং হিন্দুদের ধর্ম আচার ব্যবহার প্রভৃতি জানার তাঁদের কৌতূহল দেখা যায়। সেজন্যে তাঁরা সংস্কৃত থেকে বাংলায় রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত ইত্যাদি হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ অনুবাদের প্রেরণা দান করেন। মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গ ভাষার সৌভাগ্য ও শ্রীবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’
সুলতানি আমলের শুরুতে ফারসি ছিল রাজভাষা। আররি, উর্দু ভাষাগুলোও কখনো কখনো দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার হতো। ফলে বাংলা ভাষা নিয়ে সুলতানদের মনে নানা দ্বিধা ছিল। আরবি ছিল ধর্মীয় আবেগের ভাষা এবং মুসলমানদের কাছে পবিত্র ভাষা। কিন্তু দেশ শাসন করতে গেলে সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছানো এবং নবদীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে তখনো আরবি কিংবা ফারসি ভাষা কঠিন হওয়ায় সুলতানরা বাংলা ভাষাকেই সহজীকরণ করে তোলেন। মধ্যযুগে সুফি দরবেশরা এ দেশের অধিবাসীদের স্থানীয় কথ্য ভাষায় ধর্ম প্রচার করতেন, কেননা তারা এর মাধ্যমেই কেবল জনসাধারণের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আসতে পারতেন। ফলে সাধারণ মানুষের নিকট ইসলাম প্রচার ও তাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের ফলে বাংলা ভাষা এক নতুন প্রাণের সঞ্চার করে।
সুলতানদের নির্দেশে কুরআন ও অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তকাদি থেকে ধর্মের বাণী শোনানোর জন্য রচিত হতে থাকে নানা রকমের আখ্যান কাব্য। উদ্দেশ্য ছিল প্রেমকাহিনীর মাধ্যমে নীতি শিক্ষা বা মহান আল্লাহর মহিমা প্রচার করা। সুলতানি আমলে বাংলা ভাষায় রচিত প্রাথমিক পর্যায়ের এ ধরনের রচনাবলির মধ্যে ছিল ইউসুফ জুলেখা, গাজী বিজয়, লাইলি মজনু, সাইফ উল মূলক প্রভৃতি। বাংলা কাহিনীকাব্যে ধর্মভাবের পাশাপাশি মানবপ্রেমের আবেগ-উচ্ছ্বাস, পাশাপাশি ইসলামের বিজয়গৌরবও ফলাও করে বয়ান করার ফলে দ্রুতই পাঠযোগ্যতা বাড়তে থাকে। অপরপক্ষে বাংলার জনসংখ্যায় হিন্দু মুসলিম মিশ্রিত থাকায় হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক গ্রন্থাদি থেকেও বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রেও সুলতানরা পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। সংস্কৃত ভাষার খোলস থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয় ভগবত, রামায়ণ ও মঙ্গলকাব্যগুলো। দীর্ঘদিনের অবহেলিত বাংলা ভাষার প্রাণচাঞ্চল্যতা দেখা দেয়। বাংলা ভাষাকে দেয়া মধ্যযুগের সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতার অবদানকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ড. ওয়াকিল আহমেদ লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার সৌভাগ্য যে উদ্ভব-মুহূর্তে এক উদার রাজশক্তির সাহচর্য লাভ করেছে। যার ফলে তার পূর্ণ বিকাশ কেবল ত্বরান্বিত হয়নি, আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিপুল ঐশ্বর্যে সঞ্জীবিত ও নবশক্তির সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠতে পেরেছে।’
সুলতানদের মধ্যে অনেকে নিজেই কবিতা লিখেছেন। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ আরবি ও ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা’ রচনা করেন। সম্ভবত সুলতান কৃত্তিবাসকেও বাংলায় রামায়ণ লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুলতান রুকন উদ্দীন বারবক শাহর সময়ে জৈনুদ্দীন তার রাসুল বিজয় রচনা করেন ও ইবরাহিম কাওয়াম ফারসি গ্রন্থ ফারহাংই ইব্রাহিম (শরফনামা বলেও পরিচিত) রচনা করেন। রায়মুকুল ব্রশপতি মিশ্র, মালাধর বসু, কৃত্তিবাস ও কুলাধর সে সময়কার অগ্রগণ্য হিন্দু পণ্ডিত ছিলেন। সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ মালাধর বসুকে ভগবতের বাংলা অনুবাদ করার দায়িত্ব দেন। পরে কবিকে তিনি গুণরাজ খান উপাধিতে ভূষিত করেন। সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি জৈনুদ্দীন তার রসুল বিজয় কাব্য রচনা করেন।
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময়কালকে ধরা হয় বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ হিসেবে। এ সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁর যুগ বলা হয়। বৌদ্ধ ধর্মের আশ্রয়ে একসময় সর্বভারতীয় পালি ভাষা যে উন্নতি ও সংস্কৃতি মর্যাদা লাভ করেছিল। সম্রাট আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে বাংলা ভাষা এমন গৌরব লাভ করেছিল। এ সময়ে কবি-সাহিত্যিকরা ব্যাপকহারে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। সুলতান ও তার দরবারের সভাসদরা সাহিত্যচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। যেমন ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ গ্রন্থের লেখক যশোরাজ খান ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহের দরবারের কর্মচারী। যশোরাজ খান তার গ্রন্থে সুলতানকে ‘শাহ হুসেন জগত-ভূষণ’ বলে সম্বোধন করেন। কবিন্দ্র পরমেশ্বর ‘কলিকালে হরি হৈল কৃষ্ণ অবতার’ বলে সুলতানের বন্দনা করেছেন। হোসেন শাহ হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়। তার সময়ে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনূদিত হতে থাকে। অনেক রাজকর্মচারীকে সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলায় অনুবাদের দায়িত্বও দিয়েছিলেন। পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের অনুবাদ করেন। এছাড়া ‘মনসা বিজয়’ ‘বৈষ্ণবপদ’ বিজয়গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ প্রভৃতি গ্রন্থ এ সময় রচিত হয়। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের ছেলে নসরত শাহও বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আবদুল করিম লিখেছেন, হোসেন শাহী বংশে চারজন রাজা রাজত্ব করেন, এ চারজনই কবিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে অনেক মুসলমান কবি অনেক প্রেমকাব্য রচনা করেছেন। মুসলিম কবিরা বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য আরবি ও ফারসি ভাষা থেকে বহু শব্দ আমদানি করেন এবং বাংলা ভাষার জীবনীশক্তি সঞ্চার করেন। মুসলিম কবিরা বাংলা ভাষায় মরমি সাহিত্য সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেও কৃতিত্বের দাবিদার। পারস্যের জালালুদ্দিন রুমি ও অন্যান্য সুফি কবিদের গজলিয়াতের অনুসরণে তারা পদাবলি নামে পরিচিত মরমি ভাবধারার কবিতা রচনা করেন। এ পদাবলি মূলত ফারসি সাহিত্যের মসনবী। এ সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ছিল সত্যপীরের কাহিনী। মুসলিম পীর-দরবেশদের প্রতি ভক্তির ফলে হিন্দুরাও সত্যপীরের কাহিনী রচনা করতে থাকে। এর দ্বারা বাংলা সাহিত্য ব্যাপকভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয় এবং নতুন ভাবধারা, বিষয়বস্তু ও ভাষার উপাদান প্রবর্তিত হয়ে বাংলা সাহিত্য ও ভাষা আরো সম্প্রসারণ হতে থাকে। বিখ্যাত কবি আলাওলের সময়ে বাংলা ভাষায় ইসলামী ঐতিহ্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে।
সুলতানি শাসনামলে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের উন্নতি সাধিত হয়। আবার বাংলা ভাষাও বিকশিত হয়। হিন্দু মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের সম্মিলন এবং তাদের রচিত সাহিত্য ও অনুবাদ কর্মে নতুন ভাব ও ভাবনা প্রকাশিত হতে থাকে, আবার নতুন নতুন শব্দেরও সমাহার ঘটে। এভাবেই সুলতানি শাসন আমলে বাংলা ভাষায় বৈচিত্র্যপূর্ণ শব্দের সমাবেশ ঘটেছে। বাংলা ভাষারও সমৃদ্ধি হয়েছে। বাংলার সুলতানি শাসনামলের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় সুলতানি আমলের শাসকরা কেবল বাঙালির রাজনৈতিক ঐক্যই প্রতিষ্ঠা করেনি, বাংলা ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মন্তব্য করুন