ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

ছাপচিত্রে বাংলার শৈল্পিক অন্বেষা

মুহম্মদ আল মুখতাফি
প্রকাশ : ০৪ মে ২০২৫, ০৭:৪৮ পিএম
ছাপচিত্র
ছাপচিত্র

চীনে তখন হান রাজবংশের শাসন। ১০৫ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কার হলো কাগজ। শাস্ত্রীয় বাণী সংরক্ষণের জন্য চীনা পণ্ডিতরা পাঠ্য ও পবিত্র চিত্রগুলো পাথরের ফলকে খোদাই করতেন। তারপর ভেজা কাগজ পাথরের পৃষ্ঠে চাপা দিয়ে তৈরি করা হতো ছাঁচ। এবার কালির প্রলেপ দেয়ার পর তুলে নেয়া হয় কাগজটি। এভাবে কালো পটভূমির ওপর সাদা রেখার চিত্র দেখা যেত। ছাপচিত্রের ইতিহাসে এটাই প্রথম নজির। বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ছাপচিত্র তৈরির পদ্ধতিতে বিবর্তন ঘটে। ইউরোপে ছাপচিত্রের ইতিহাস চীনের মতো প্রাচীন না। সপ্তম শতাব্দীর দিকেও সেখানে মানুষ কাপড়ের ওপর মুদ্রণ করত। যখন ইউরোপ কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া শিখে ফেলল, তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১১৫১ সালে আরবরা তৎকালীন আন্দালুসের শাতিবায় কাগজ তৈরি শুরু করে। সেটাই ইউরোপে কাগজের আনুষ্ঠানিক যাত্রা। কাছাকাছি সময়ে শুরু কাগজে ছাপচিত্রেরও।

বাংলাদেশে ছাপচিত্রের ইতিহাসও কম পুরনো নয়। ঐতিহাসিকভাবেই চীনের সঙ্গে বাংলার যোগাযোগ ছিল। যেহেতু বাংলা ছিল বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র, ফলে ছাপচিত্র দ্রুত এ অঞ্চলে জনপ্রিয় শিল্পকৌশলে পরিণত হয়। এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ছাপের বিভিন্ন ধরন নিয়ে ধারণা ছিল। ছিল কাপড় অলংকরণ, ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, আলপনা, কড়ির ছাপ কিংবা লক্ষ্মীর হাত ও পায়ের ছাপের মতো লোকজ রীতির প্রচলন। গ্রামেগঞ্জে মানুষ মাটির ফলকে, কাঠের পাটায় অথবা ধাতব পাতে ছবি খোদাই করত।

বাংলাদেশে মুদ্রণ শিল্প ব্যাপকতা লাভ করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি। সে সময়কার পুস্তক অলংকরণের সঙ্গে জড়িত সীতানাথ বসাক কিংবা কেশবের মতো কয়েকজন শিল্পী সম্পর্কে জানা যায়। ঢাকা ও কলকাতা থেকে ক্রমে সচিত্র পুথি প্রকাশিত হতে থাকে। সোনাভানের পুথি, ছায়েতনামা, সচিত্র বড় ছায়েতনামা, সচিত্র ছহি বড় সোনাভান এবং সচিত্র আদি ও আসল বড় সোনাভানের মতো পুথিতে সমকালীন ছাপচিত্রের হালচাল সম্পর্কে জানা যায়। যদিও এসব ছবিতে শিল্পীর কোনো নাম বা পরিচিতি নেই। তবে তাদের দক্ষতা আন্দাজ করতে ভুল হয় না।

ছাপচিত্রচর্চায় সৃজনশীল তথা মূলধারা বলতে যা বোঝা যায় তা শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। সে বছর জয়নুল আবেদিন ও তার সঙ্গীদের দ্বারা ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানটির পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয় ছাপচিত্র, যার নেতৃত্ব দেন শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ। জয়নুল আবেদিনের সহযোগিতা এবং সফিউদ্দিন আহমেদ ও হবিবর রহমানের মতো শিল্পী শিক্ষকদের যৌথ প্রচেষ্টা এ দেশে মাধ্যমটির চর্চা ও বিস্তারে যথেষ্ট গতিসঞ্চার করে। পঞ্চাশের দশকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গণ্ডি অতিক্রম করে রশিদ চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, মুর্তজা বশীর, নিতুন কুন্ডুর মতো শিল্পীরা চর্চা করেন ছাপচিত্র। ক্রমে বাড়তে থাকে ছাপচিত্রচর্চার আখ্যান। একে একে যুক্ত হয় হামিদুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী, কাইয়ুম চৌধুরীর মতো নাম। তারা ছাপচিত্রের মাধ্যমে কিছু স্মরণীয় শিল্প সৃষ্টি করেছেন। প্রবীণ শিল্পীদের বিকাশমান প্রচেষ্টায় হাত মেলান তরুণরা। ফলে ছাপচিত্রের সামগ্রিক মর্যাদা আরো উচ্চতায় উন্নীত হয়। কয়েকজন তরুণ ছাপচিত্রী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করলে বাংলাদেশের ছাপচিত্র আরো গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাপচিত্র বিভাগের স্টুডিওতে ব্যবহারের জন্য জাপানি অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত বিশেষভাবে নির্মিত একটি আধুনিক লিথোগ্রাফ এবং একটি এচিং মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয়। এ নতুন সংযোজন সৃজনশীল নিরীক্ষা ও উন্নত মানের ছাপচিত্র সৃষ্টিতে বিশেষ সহায়কের ভূমিকা পালন করে।

ষাটের দশকে দেশের ছাপচিত্রচর্চায় নতুন মাধ্যম হিসেবে যোগ হয় ড্রাইপয়েন্ট। শুরু হয় বহুবর্ণিল লিথোগ্রাফ ও উডকাটের প্রচলনও। মো. হুসনে জামাল আলাদা কাঠ ও রঙ ব্যবহার করে রঙিন কাঠ খোদাই করেন। ক্রমে তরুণদের মধ্যে ছাপচিত্র বলতে সাদা-কালো এবং একঘেয়ে বলে যে অবহেলা ছিল তাও অপসারিত হয়। বরং চিত্রকলার কাছাকাছি ফলাফল লাভের দরুন ছাপচিত্র সম্পর্কে ছাত্রদের মনে বাড়তি আগ্রহ জন্ম নেয়। সত্তরের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশে ছাপচিত্র নতুন মাত্রা লাভ করে। তবে আশির দশক থেকে দেশে শিক্ষিত নিয়মিত ছাপচিত্রীর দেখা পাওয়া যায়। শুরু থেকে এ সময় পর্যন্ত যাদের ছাপচিত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাদের সবাই ছাপচিত্রে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন বিদেশে। আশির দশকে এসে এ অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করা যায় ছাপচিত্রে বিশেষায়িত বিএফএ ও এমএফএ ডিগ্রি চালুর সুবাদে।

দেশের ছাপচিত্রের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা প্রিন্টমেকার্স। প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা পরবর্তী সময়ে ছাপচিত্রের বাঁক বদলে সহযোগিতা করেছেন। নব্বইয়ের দশকেই নারায়ণগঞ্জ আর্ট কলেজ, বগুড়া আর্ট কলেজ ও রাজশাহী চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলে ছাপচিত্রচর্চার গণ্ডি আরো প্রসারিত হয়। এ সময়ে বেসরকারি উদ্যোগেও বেশ জোরালোভাবেই নানা কর্মশালা আয়োজন হতে থাকে। দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষকদের হাত ধরে ঘটে নানামুখী উত্তরণ।

সাম্প্রতিক দিনগুলোয় দেশে ছাপচিত্রের মেশিন তৈরির ক্ষেত্রে রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগেও গড়ে উঠেছে অনেক ছাপচিত্র স্টুডিও। স্টুডিওগুলো সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে আয়োজন করছে ছাপচিত্র মেলা, কর্মশালা, প্রদর্শনীর। ফলে ছাপচিত্র সম্পর্কে শিল্পানুরাগী ও সাধারণ মানুষের ধারণারও ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মূলত আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ছাপচিত্রচর্চার সামগ্রিক পরিবেশ অনুকূল। ছাপচিত্রকলার চর্চা চল্লিশের দশকে শুরু হলেও নানা সীমাবদ্ধতায় ষাটের দশক পর্যন্ত ব্যাপকতা লাভ করতে পারেনি। কিন্তু সত্তরের দশকের সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ মাধ্যমের প্রকৃত কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে এসে তা নানামুখী নিরীক্ষা ও চর্চায় নতুন নতুন আঙ্গিক-বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়ে প্রকৃত বৈচিত্র্য অর্জন করে।

তথ্যসূত্র:

১. The Printed Image in the West: History and Techniques, Wendy Thompson, The Metropolitan Museum of Art

২. The state of printmaking in Bangladesh, Sarah Nafisa Shahid

৩. ছাপাই মাধ্যমের ক্রমবিকাশের ধারায় সৃজনশীল ছাপচিত্র (১৯৪৮-২০০০): পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ, নিত্যানন্দ গাইন

৪. G.W Shaw. Printing and Publishing in Dhaka1849-1900, in Sharif Uddin Ahmed edited, Dhaka

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

৩০ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা দেশ কখনোই সভ্য হতে পারে না

২৯ জুন ১৯৭১: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ

২৮ জুন ১৯৭১: ইয়াহিয়ার সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় সরকার গঠনের প্রস্তাব ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

২৬ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা

বিদ্রোহ করবেন না? লড়বেন না পরেশ ও বিষ্ণুদের জন্যে?

মব সন্ত্রাস / বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সামাজিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সংকট

১০

নারীর সুন্দর পোশাকে মাদক খোঁজা—উপদেষ্টার ‘সমাজবিজ্ঞান’

১১

নারীর প্রতি সহিংসতা ও আমাদের সমাজের বিকৃত চিত্র

১২

সৈয়দপুরে পাঁচ মাড়োয়ারী নারীর জহরব্রত – সতীত্ব রক্ষার মর্মান্তিক আত্মবলিদান

১৩

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে খোয়াই নদীর পাড়ে নির্মম গণহত্যা

১৪

২৫ জুন ১৯৭১: গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

১৫

মোসাদ্দেক থেকে মৌলবাদ: ইরানের ইতিহাস ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

১৬

বসুনিয়াপাড়া-বাড়াইপাড়া গণহত্যা: কিশোরগঞ্জের এক কলঙ্কিত অধ্যায়

১৭

২৪ জুন ১৯৭১: মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

১৮

ধর্মীয় পরিচয়-রাজনীতির বিবর্তন / সাম্প্রদায়িকতা - মৌলবাদ - জঙ্গিবাদ - ‘আমেরিকান’ ইসলামবাদ

১৯

৭২-এর সংবিধান বাতিলের ষড়যন্ত্র: মুখোশ খুলে ফেলো!

২০