ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

বুরুঙ্গা গণহত্যা: ৯৪ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
২৬ মে ২০২৫, ০১:২১ পিএম
২৪ জুন ২০২৫, ০১:১৩ পিএম
বুরুঙ্গা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ | ছবি: সংগৃহীত
বুরুঙ্গা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ | ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ২৬ মে। মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম নৃশংস এক গণহত্যার সাক্ষী হয় সিলেটের বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা গ্রাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের হাতে সেদিন নির্মমভাবে প্রাণ হারান ৯৪ জন নিরীহ বাঙালি। শান্তি কমিটির নামে ফাঁদে ফেলে, স্কুল মাঠে জড়ো করে ব্রাশফায়ার—এই গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। আজও বুরুঙ্গাবাসীর স্মৃতিতে গাঁথা সেই মর্মন্তুদ দিনের কথা।

গণহত্যার পটভূমি

বুরুঙ্গা, সিলেটের বালাগঞ্জ থানার একটি শান্তিপ্রিয় গ্রাম। বুড়িবরাক নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রামে বসবাস করত হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সহাবস্থান। কিন্তু ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি বাহিনীর আতঙ্কে গ্রামবাসীর জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।

শান্তি কমিটির ফাঁদ

২৫ মে বিকেলে স্থানীয় চেয়ারম্যান ইনজাদ আলী ও শান্তি কমিটির নেতা ছয়েফ উদ্দিন মাস্টার ঘোষণা দেন, "২৬ মে বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ে শান্তি কমিটির সভা হবে। সবাইকে উপস্থিত হতে হবে। সেখানে শান্তি কার্ড বিতরণ করা হবে।"

আশ্বাস দেওয়া হয়, "এই কার্ড থাকলে পাকিস্তানি সেনারা কাউকে ক্ষতি করবে না।"

ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসী, বিশেষত হিন্দু পরিবারগুলো, শান্তি কমিটির এই আশ্বাসে আংশিকভাবে বিশ্বাস করে।

২৬ মে: রক্তঝরা সেই সকাল

ভোর ৬টায় থেকেই গ্রামবাসী স্কুল মাঠে জড়ো হতে শুরু করে। সকাল ৮টার মধ্যে ১,০০০-এর বেশি মানুষ (নারী-পুরুষ-শিশু) মাঠে উপস্থিত হয়। সকাল ৯টায় ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিনের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে প্রবেশ করে। স্থানীয় রাজাকার নেতা আব্দুল আহাদ চৌধুরী ও ডা. আব্দুল খালেক তাদের সহযোগিতা করে। তালিকা মিলিয়ে হিন্দু ও মুসলিমদের আলাদা করা হয়।

এই মাঠেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করেছিল হানাদাররা

হত্যাযজ্ঞের নীলনকশা

হিন্দুদের আলাদা করে বেঁধে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। মুসলিমদের বলা হয় কালিমা পাঠ ও পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে। কিছু মুসলিম যুবককে নাইলনের দড়ি এনে হিন্দুদের হাত-পা বাঁধতে বাধ্য করা হয়।

ব্রাশফায়ার

দুপুর ১২টার দিকে হিন্দুদের লাইনে দাঁড় করিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি চালানো হয়। ৯৪ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন বৃদ্ধ, নারী ও শিশু।

লাশ পোড়ানো ও লুটপাট

গুলিবিদ্ধ লাশে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানো হয়। রাজাকাররা গ্রামের বাড়িঘর লুট করে অগ্নিসংযোগ করে।

যারা বেঁচে গিয়েছিলেন: প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানি

প্রীতিরঞ্জন চৌধুরী (শিক্ষক, বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়) "আমি স্কুলের ভাঙা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়েছিলাম। পেছনে ব্রাশফায়ারের শব্দ শুনলাম। রানু মালাকারসহ কয়েকজন আমার সঙ্গে পালাতে পেরেছিলেন। বাকিরা..."

শ্রীনিবাস চক্রবর্তী (আহত, পরে উদ্ধারপ্রাপ্ত) "আমি গুলিবিদ্ধ হয়েও মৃতের ভান করেছিলাম। হানাদাররা ফিরে এসে আবার গুলি করল। আমার পিঠে গুলি লাগলেও বেঁচে গেলাম। আমার বাবা-ভাইসহ ৯৪ জনকে হারালাম..."

রাম রঞ্জন ভট্টাচার্যের মৃত্যু সিলেট জজ কোর্টের এই উকিলকে চেয়ার থেকে উঠতেই পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গণহত্যার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিশোধ: ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী আব্দুল আহাদ চৌধুরী ও ডা. আব্দুল খালেককে গ্রেপ্তার করে।

স্মৃতিস্তম্ভ: বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নির্মিত হয়েছে শহীদ বেদী।

ইতিহাসের দায়বদ্ধতা

বুরুঙ্গা গণহত্যা শুধু একটি সংখ্যা নয়—এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাম্প্রদায়িক নির্মমতার চূড়ান্ত প্রকাশ। আজও এই গণহত্যার বিচার হয়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

"যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী-যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান..." —কিন্তু বুরুঙ্গার শহীদদের নামও যেন ভোলা না হয়।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র (ত্রয়োদশ খণ্ড)

সিলেটে গণহত্যা – তাজুল মোহাম্মদ

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার (প্রীতিরঞ্জন চৌধুরী, শ্রীনিবাস চক্রবর্তী)

স্থানীয় ইতিহাস গবেষকদের বিবরণ

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৯ জুলাই ১৯৭১: আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও প্রতিরোধের গৌরব

সুরমা পুকুরপাড় গণহত্যা: আনোয়ারার রক্তাক্ত ৭ জুলাই ১৯৭১

সরিষাবাড়ি ও পাতপাড়া গ্রাম গণহত্যা: জামালপুরের বীরত্ব ও বেদনা

বান্দাইখাড়া গণহত্যা: নওগাঁর আত্রাইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা

বরুণা বাজার গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর নির্মম অধ্যায়

চেঁচুড়ি গণহত্যা: জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এর নির্মম ঘটনাবলি

খলশি গণহত্যা: জুলাই-নভেম্বর ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

কালীনগর গণহত্যা: জুলাই ১৯৭১-এর এক নির্মম অধ্যায়

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

মব ভায়োলেন্স প্রতিরোধে সদিচ্ছার অভাব

১০

মব সন্ত্রাসে অতিষ্ঠ দেশ

১১

নারীশিক্ষা বনাম বাল্যবিয়ে

১২

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

১৩

৫ জুলাই, ১৯৭১: মুজিবনগরে গণপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক বৈঠক

১৪

২ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

১৫

মিট্টিকুলাস পুলিশ হত্যা

১৬

১ জুলাই ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাখ্যান

১৭

ধামুসা গণহত্যা (কালকিনি, মাদারীপুর)

১৮

৩০ জুন ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট

১৯

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা দেশ কখনোই সভ্য হতে পারে না

২০