বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ গত ১০ মে রাতে তার ৭৬ বছরের ইতিহাসে সপ্তমবারের মতো নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের সব রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটির নেতাদের বিচার চলাকালীন সময়ে।
নিষেধাজ্ঞার সাতটি অধ্যায়
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সাতটি ভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা বা কার্যত নিষ্ক্রিয় অবস্থার শিকার হয়েছে:
১. ১৯৫৮: আইয়ুব খানের সামরিক শাসন
পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি করে সকল রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।
২. ১৯৭১: ইয়াহিয়া খানের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে “রাষ্ট্রদ্রোহী” ঘোষণা করে নিষিদ্ধ করেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাকে ত্বরান্বিত করে।
৩. ১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী দমন
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দেয়। ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডে দলের চার প্রধান নেতা নিহত হন।
৪. ১৯৮২-১৯৯০: এরশাদের সামরিক শাসন
জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনামলে আওয়ামী লীগের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ছিল। শেখ হাসিনাকে চার দফা গৃহবন্দি করা হয়।
৫. ২০০১-২০০৬: বিএনপি-জামায়াতের নিপীড়ন
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা তীব্র হয়।
৬. ২০০৭-২০০৮: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দমন
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে এবং "মাইনাস টু" নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা করে।
৭. ২০২৫: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের দেশত্যাগ ও বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যেই ১০ মে ২০২৫ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
৭৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকট মোকাবিলা করছে আওয়ামী লীগ। এবারের নিষেধাজ্ঞা কেবল একটি দলের জন্য নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মন্তব্য করুন