ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪৮ এএম
Bir Sreshtho Mohamad Mostafa Kamal

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কিছু নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে—তাঁদের জীবন ও মৃত্যু এক জাতির চেতনার ভিত্তি হয়ে ওঠে। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল তেমনই একজন, যিনি অকুতোভয় দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ এবং অসম সাহসিকতার মাধ্যমে অমর হয়ে আছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে।

জন্ম ও পারিবারিক জীবন মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে। তাঁর পিতা হাবিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সিপাহী। মা মালেকা বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী। সংসারে ছিলেন ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়।

শৈশব থেকেই মোস্তফা ছিলেন মিশুক, সাহসী ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন। খেলাধুলা, বিশেষ করে কাবাডি ও ফুটবলে ছিলেন পারদর্শী। পরিবারে দারিদ্র্য থাকলেও তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল দারুণ প্রশংসনীয়।

সেনাবাহিনীতে যোগদান মোস্তফা কামাল ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর (নিজের জন্মদিনেই) পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ রাইফেলম্যান এবং পরবর্তীতে আলফা কোম্পানির ২ নম্বর প্লাটুনের সেকশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মোস্তফা কামাল তাঁর ইউনিটের সঙ্গে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও তার পার্শ্ববর্তী দরুইন গ্রামে অবস্থান নেয়।

শহীদ হওয়ার ঘটনা: দরুইন যুদ্ধ ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়। পাকিস্তানি বাহিনী আশুগঞ্জ রেল সেতু পুনর্দখলের জন্য বারবার আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৭ এপ্রিল থেকে দরুইন গ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়। মোস্তফা কামাল ছিলেন সম্মুখভাগের কমান্ডে। প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মধ্যে তিনি একা থেকে সহযোদ্ধাদের সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।

তিনি গুলি চালিয়ে বহু পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করেন। কিন্তু একসময় তাঁর গুলি শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে ঘিরে ধরে এবং নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর ৪ মাস।

মর্যাদা ও স্বীকৃতি মোস্তফা কামালের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্বীকৃত হন।

স্মৃতিরক্ষা ও উত্তরাধিকার তাঁর নামে বরিশালে একটি সেনানিবাসের নামকরণ করা হয়েছে—“বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল সেনানিবাস”। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ভোলা ও অন্যান্য স্থানে রয়েছে তাঁর নামে সড়ক ও প্রতিষ্ঠান। জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

বীরশ্রেষ্ঠর চেতনায় প্রজন্ম মোস্তফা কামাল কেবল একজন সৈনিক নন, তিনি বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। তাঁর আত্মত্যাগ আমাদের শিখিয়েছে—একটি জাতির স্বাধীনতা কখনো বিনা রক্তে আসে না। দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা মানুষগুলোই আসলে প্রকৃত নেতৃস্থানীয়।

মোস্তফা কামাল বলেছিলেন—"আমার চেয়ে সহযোদ্ধাদের প্রাণের দাম বেশি"। তাঁর এই আত্মউৎসর্গই তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ করেছে। জাতি চিরকাল তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০