১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ও নলশোদা গ্রামে সংঘটিত গণহত্যা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের নৃশংসতার একটি মর্মান্তিক অধ্যায়। ৩০ জুলাই ১৯৭১ তারিখে এই গণহত্যায় দুটি গ্রামের সাতজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। এই ঘটনায় গ্রামের বাড়িঘর লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, যা হিন্দু অধ্যুষিত এই গ্রামগুলোর উপর পরিকল্পিত আক্রমণের প্রমাণ বহন করে।
গ্রামের অবস্থান ও পটভূমি
পাথরাইল ও নলশোদা গ্রাম টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং দেলদুয়ার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এই দুটি পাশাপাশি গ্রাম হিন্দু অধ্যুষিত এবং স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জুলাই মাসের শেষদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বীরপুশিয়া গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আনছার আলীর সহায়তায় এই গ্রাম দুটি রেকি করে। এই রেকির ফলে ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের অধিকাংশ পালিয়ে যান।
রাজাকার আনছার আলী তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে পাথরাইল বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করত। এই চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় পাথরাইল ইউনিয়ন কাউন্সিলের বিশিষ্ট সদস্য ও ব্যবসায়ী জগন্নাথ বসাক আনছার আলীর বিশেষ টার্গেটে পরিণত হন। এই প্রতিবাদ তাকে এবং তার সম্প্রদায়কে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের ক্রোধের শিকার করে।
গণহত্যার ঘটনা
৩০ জুলাই ১৯৭১ ভোর ৫টার দিকে করটিয়া সা’দত কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে প্রায় ৪০ জনের একটি দল বের হয়। তারা প্রথমে বীরপুশিয়া গ্রামে পৌঁছে এবং সেখান থেকে দুটি দলে বিভক্ত হয়। একটি দল পাথরাইল গ্রামে এবং অপর দলটি নলশোদা গ্রামে প্রবেশ করে।
পাথরাইল গ্রামে প্রবেশের আগে হানাদার বাহিনী পাথরাইল বাজার লুটপাট করে এবং বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর তারা গ্রামে ঢুকে বাড়িঘরে লুটপাট চালায় এবং তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। একইভাবে, নলশোদা গ্রামে প্রবেশ করে দ্বিতীয় দলটি বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এই নৃশংস অভিযানে দুটি গ্রামের মোট সাতজন নিরীহ মানুষ নিহত হন।
শহীদদের তালিকা
নিম্নে গণহত্যায় শহীদ ব্যক্তিদের নাম ও তাদের বিবরণ দেওয়া হলো:
জগন্নাথ বসাক (পিতা: জানকীনাথ বসাক, পাথরাইল)
ভোলানাথ বসাক (পিতা: যদুনাথ বসাক, পাথরাইল)
বিশ্বনাথ বসাক (বিশা) (পিতা: সর্বমঙ্গল বসাক, পাথরাইল)
দুলাল বসাক (পিতা: বিশ্বনাথ বসাক, নলশোদা)
বিশ্বনাথ বসাক (নলশোদা)
অমিত কুমার বসাক (পিতা: বিশ্বনাথ বসাক, নলশোদা)
ঠাকুর দাস বসাক (নলশোদা)
গণহত্যার পটভূমি ও প্রভাব
এই গণহত্যা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের পরিকল্পিত আক্রমণের অংশ, যার লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়কে ভীতি প্রদর্শন ও তাদের সম্পত্তি ধ্বংস করা। রাজাকার আনছার আলীর নেতৃত্বে এই অভিযান গ্রামবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়ায় এবং অধিকাংশ মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। জগন্নাথ বসাকের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আক্রমণ এই অঞ্চলে প্রতিরোধের কণ্ঠকে দমন করার প্রচেষ্টা ছিল।
পাথরাইল ও নলশোদা গ্রামের বাড়িঘর ও বাজার পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে স্থানীয় অর্থনীতি ও সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পরিকল্পিত নিপীড়ন ও নৃশংসতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পায়।
পাথরাইল-নলশোদা গণহত্যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের হাতে সাতজন নিরীহ মানুষের প্রাণহানি, বাড়িঘর ও বাজার ধ্বংস এই অঞ্চলের মানুষের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের ত্যাগ ও দুর্ভোগের একটি নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ৫ম খণ্ড
মন্তব্য করুন