ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

ক্র্যাক প্লাটুনের অদম্য সাহসিকতা ও ত্যাগের গল্প

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১১:০৫ পিএম
আর কোনো দিন ফিরে আসেনি আজাদ | ছবি: বাংলাদেশ আর্কাইভ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা শহর ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র। ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের দুর্ধর্ষ আক্রমণের মাধ্যমে হানাদারদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। গ্যানিজ পেট্রল পাম্প, উলন পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং ইউএস ইনফরমেশন সেন্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল। এমনকি কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ঘেরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেও তারা দুই দফা হামলা চালায়।

অস্ত্র ও সুর দুটো দিয়েই যুদ্ধ করেছেন আলতাফ মাহমুদঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কাছে ফার্মগেটের মতো সুরক্ষিত চেকপোস্টও তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। ভারি মেশিনগান দিয়ে সুরক্ষিত এই চেকপোস্টও গেরিলাদের কাছে অধরা ছিল। ২৫ আগস্ট ধানমন্ডির ২০ নম্বর সড়কে চীনা দূতাবাস এবং ১৮ নম্বর সড়কে বিচারপতি আবদুল জব্বার খানের বাসার সামনে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলায় ৭ জন হানাদার নিহত হয়। এসব হামলায় হানাদারদের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক এবং হতাশা ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকায় গেরিলা গঠনের চিন্তাটা খালেদ মোশাররফের মস্তিষ্কপ্রসূতহানাদারদের প্রতিশোধমূলক অভিযান

গেরিলাদের এই সফল আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা গেরিলাদের ধরতে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি এবং গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করে। পাকিস্তানপন্থীদের তথ্য সরবরাহের জন্য নানা পুরস্কারের প্রলোভন দেখানো হয়। এর ফলস্বরূপ, ২৯ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন থেকে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা বদিউল আলম বদি ধরা পড়েন। তাকে এনএসএফ কর্মী ফরিদ, যিনি বদির বন্ধু ছিলেন, তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেন।

ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে মাতৃভূমির সার্বভৌমত্বের জন্যই লড়াইকেই বেছে নিলেন রুমী

লিনু বিল্লাহ, ক্র্যাক প্লাটুনের একন মুক্তিযোদ্ধা, বলেন, "ফরিদদের বাসায় বদি নিয়মিত তাস খেলতে যেতেন। সেদিনও তিনি তাস খেলছিলেন। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি ঘিরে ফেলে। বদি জানালা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন এবং ধরা পড়েন।"

নির্যাতন ও তথ্য ফাঁস

আটকের পর বদিকে নাখালপাড়ার মিলিটারি টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। একই দিন বিকেল ৪টার দিকে ইস্কাটনের একটি বাসা থেকে গেরিলা আবদুস সামাদকেও আটক করা হয়। তীব্র নির্যাতনের মুখে তিনি সহযোদ্ধাদের নাম ও অবস্থান প্রকাশ করে দেন।

ক্র্যাক প্লাটুন: ‍মুক্তিযুদ্ধের তারুণ্য ভরা এক অধ্যায়

আবদুস সামাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানি বাহিনী রাত ২টার দিকে বড় মগবাজারের একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখান থেকে মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ, আবদুল হালিম জুয়েল, সাংবাদিক আবুল বাশার, সেকান্দার হায়াত খান এবং মনোয়ার ধরা পড়েন। তবে কাজী কামাল হানাদারদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি চালিয়ে পালাতে সক্ষম হন।

প্রত্যক্ষদর্শী গোলাম গাউসে আজম বলেন, “রাত ২টার দিকে পাকিস্তান সেনারা গেরিলাদের ধরতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে। তারা আজাদকে খুঁজছিল। আজাদকে দেখেই তারা তাকে চিনে ফেলে। আমাকে স্টোররুমে নিয়ে গিয়ে তারা একটি পিস্তল ও ফসফরাস পায়। পাকিস্তানি মেজর সরফরাজ আজাদকে ঘুষি মারতেই কাজী কামাল স্টেনগান কেড়ে নিয়ে গুলি করে পালিয়ে যান।”

গণআটক ও নির্যাতন

একই রাতে এলিফ্যান্ট রোডের 'কণিকা' বাড়ি থেকে শাফী ইমাম রুমী, সাইফ ইমাম জামী, শরীফ ইমামসহ বাড়ির সব পুরুষ সদস্যকে আটক করা হয়। পুরানা পল্টন থেকে আজিজুস সামাদ, মালিবাগ থেকে শামসুল হক, ফার্মগেটের বিমানবন্দর সড়ক থেকে আবুল বাসার এবং নিউ ইস্কাটন রোড থেকে সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে আটক করা হয়। ৩০ আগস্ট ভোরে রাজারবাগের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের একটি বাড়ি থেকে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক আলভী, লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ, খাইরুল আলম বিল্লাহসহ ১২ জনকে আটক করা হয়।

ইশতিয়াক আজিজ উলফাত বলেন, "২৯ আগস্ট রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ৪৪টি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৩০-৩৫ জন গেরিলা ও তাদের স্বজনকে আটক করে। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন মেজর সরফরাজ ও ক্যাপ্টেন বোখারি।"

আটককৃতদের তেজগাঁও নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনটি ভবনে তাদের ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হয়। আবুল বারাক আলভী বলেন, "নির্যাতনের তীব্রতা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো গোলাবারুদ কোথায়, কারা আমাদের সঙ্গে ছিল। আমি সবকিছু অস্বীকার করেছি। তারা আমাকে লাঠি ও বেত দিয়ে পিটিয়েছে, যতক্ষণ না রক্ত ঝরতে শুরু করে। তবুও আমি সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করিনি। ভাগ্যক্রমে আমি ফিরে আসতে পেরেছিলাম।"

১১ গেরিলার চিরনিদ্রা

১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বেশিরভাগ গেরিলা মুক্তি পেলেও ক্র্যাক প্লাটুনের ১১ জন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা—বদিউল আলম বদি, শাফী ইমাম রুমী, মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ, আবদুল হালিম জুয়েল, সৈয়দ হাফিজুর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, আবু বকর, আবুল বাশার, আবুল বাসার, আবদুল্লাহ হিল বাকী এবং সেকান্দার হায়াত খান—আর ফিরে আসেননি। ধারণা করা হয়, ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের হত্যা করা হয়। তাদের এই ত্যাগ ও সাহসিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড।

ক্র্যাক প্লাটুন: ঢাকায় মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন যারা, দ্য ডেইলি স্টার (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০