ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১৮ জুলাই ১৯৭১: ভারতীয় সেনাপ্রধান হঠাৎ কলকাতায়

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৬ পিএম
১৮ জুলাই ১৯৭১: ভারতীয় সেনাপ্রধান হঠাৎ কলকাতায়

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বহু ঘটনার অবদান রয়েছে। এখানে তুলে ধরা হলো একাত্তরের প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের কলকাতা সফর

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৮ জুলাই হঠাৎ বিকেলে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আসেন। তিনি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে তাঁর এই সফর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। দীর্ঘ বৈঠক শেষে তিনি সন্ধ্যায় রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজভবনে যান।

ইয়াহিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের প্রতিবাদ

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের হুমকি দিলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ মুজিবনগর থেকে একটি জোরালো বিবৃতি দেন। তিনি শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন বন্ধ করে তাঁর জীবন রক্ষার জন্য জাতিসংঘ ও মহাসচিব উ থান্টের কাছে জরুরি আবেদন জানান। মোশতাক আহমদ স্পষ্ট করেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শেখ মুজিবের বিচার করার কোনো আইনগত অধিকার ইয়াহিয়ার নেই।

কলকাতায় পাকিস্তানি মিশন কর্মীদের আনুগত্য ঘোষণা

সুইজারল্যান্ডের মধ্যস্থতায় কলকাতায় তৎকালীন পাকিস্তানি উপহাইকমিশনের কর্মীদের গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রায় ৬৭ জনের মধ্যে ৬৪ জন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং পাকিস্তানে ফিরে যেতে অস্বীকার করেন। মাত্র দুজন অবাঙালি কর্মী পাকিস্তান ফেরতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই প্রক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন সুইস কাউন্সেলর ড. বোনার্ড, সাবেক পাকিস্তানি উপহাইকমিশনার মেহেদি মাসুদ এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব অশোক রায়

মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ কলকাতার রংমহলে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে আলোচনা, সংগীত ও নাট্য পরিবেশনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সত্যেন সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। সংগীত পর্বে ১৫টি প্রতিরোধের গান পরিবেশিত হয়, যেখানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ১৬ জন শিল্পী অংশ নেন। নাট্যাংশে পূর্ণেন্দু পালের রচনা ‘বিদ্রোহী বাংলা’ মঞ্চস্থ হয়।

ব্রিটেনে বাঙালিদের প্রতিবাদ

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত প্রায় দুই হাজার বাঙালি লন্ডনে পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা মার্কিন ও চীনা দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ জানিয়ে স্মারকলিপি জমা দেন। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন প্রতিনিধি স্মারকলিপি গ্রহণ করলেও চীনা দূতাবাস বন্ধ থাকায় তা ডাকবাক্সে জমা দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান

ঢাকায় গেরিলা আক্রমণ

মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঢাকার জিন্নাহ অ্যাভিনিউ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) এলাকায় গ্যানিজ ও ভোগ বিপণিকেন্দ্রে সফল গেরিলা আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানপন্থী পুলিশ ও রাজাকারদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ও ফসফরাস বোমা নিক্ষেপ করা হয়, যার ফলে দোকান দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যুদ্ধ

  • শালদানদী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা মর্টার ও কামানের গোলাবর্ষণে প্রতিহত করেন।

  • ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কাসিমপুর সেতু এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করেন।

  • সুবেদার আবদুল ওহাবের (বীর বিক্রম) নেতৃত্বে আরেক দল পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান ধ্বংস করে, যেখানে শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

অন্যান্য অঞ্চলের সংবাদ

  • শরীয়তপুরের গোসাইরহাট থানার দামুদিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাঁচটি রাইফেল, একটি ওয়্যারলেস সেট ও গোলাবারুদ দখল করেন।

  • ময়মনসিংহে টেলিফোন লাইন কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

  • রংপুরের বড়খাতা ও চৌইলাদি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

সূত্র:

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২, ৭ ও ১১)

  • ইত্তেফাক, ১৯ ও ২০ জুলাই ১৯৭১

  • আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ১৯-২১ জুলাই ১৯৭১

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০