ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

৭ জুলাই ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের সিদ্ধান্তমুখর দিন

​​​​​​​মুজিবনগর সরকারের ঐতিহাসিক ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা
প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৭ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৯ পিএম
মুক্তিযুদ্ধে চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়েছে। এই ছবিটি একটি প্রমাণ। কারণ পশ্চিম দিনাজপুর হিলি সীমান্তের কাছে পাকিস্তানীদের ব্যবহৃত শেলগুলোর খোসায় চাইনিজ ভাষা লেখা ছিলো। ছবিটি ৩ জুন ১৯৭১ সালের যুগান্তর পত্রিকার ১ম পৃষ্ঠার ৫-৭ নং কলাম থেকে উদ্ধৃত।

১৯৭১ সালের ৭ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত। এদিন মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সমাপনী বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—“আর আলোচনায় নয়, মুক্তি এখন যুদ্ধে।” স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ এই দিনে।

১. মুজিবনগর সরকারের দৃঢ় অবস্থান

স্বাধীনতার অপরিহার্যতা ঘোষণা

মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন:

“পরিপূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বিকল্প কোনো প্রস্তাব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি ইয়াহিয়া খানের সরকারের প্রতি ৪টি শর্ত পুনর্ব্যক্ত করেন:

অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার

বাংলাদেশের জনগণের ক্ষতিপূরণ

২৮ জুন ইয়াহিয়া খানের প্রত্যুত্তর আলোচনার পথ রুদ্ধ করায় নজরুল ইসলাম বলেন:

“এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে যুদ্ধের মাধ্যমে—মাঠে, প্রান্তরে, নদীর কূলে।”

রণকৌশল ও নেতৃত্ব

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন:

  • প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

  • মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ

  • ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য

  • ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য

সিদ্ধান্তসমূহ:

  • মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর করা

  • বর্ষার আগেই যতটা সম্ভব বেশি অঞ্চল মুক্ত করা

  • প্রতিটি মুক্তাঞ্চলের দায়িত্ব স্থানীয় গণপ্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত

২. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ

ইন্দিরা গান্ধী-কিসিঞ্জার বৈঠক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-এর সঙ্গে ৪০ মিনিট আলোচনা করেন। ইন্দিরা গান্ধী জোর দিয়ে বলেন:

“শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার জন্য বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন। নতুবা তারা ফিরবে না।” কিসিঞ্জার নিক্সনের একটি চিঠিও হস্তান্তর করেন।

পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা

  • পশ্চিম জার্মানি: অর্থনৈতিক সহযোগিতা মন্ত্রী ড. ব্রাহার্ড এপলার স্পষ্ট বলেন, পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করা হবে যদি তারা বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধান না করে।

  • কানাডা: সংসদীয় প্রতিনিধিদল কলকাতায় ঘোষণা করেন, "পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব নেই—বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা।"

  • যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: ভারতের কমিউনিস্ট নেতা ভুপেন গুপ্ত ও কংগ্রেস সদস্য শশিভূষণ-এর নেতৃত্বে ২০ জন সাংসদ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে বিক্ষোভ করেন।

বাঙালি কূটনীতিকদের বিদ্রোহ

ফ্রান্সের পাকিস্তান দূতাবাসের দুই কূটনীতিক মোশাররফ হোসেনশওকত আলী রাজনৈতিক আশ্রয় চান। তারা অভিযোগ করেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছিল এবং অপমানজনক আচরণ করেছিল।

৩. পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা

বুদ্ধিজীবী হত্যার অপপ্রচার

দ্য টাইমস পত্রিকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মোহর আলী একটি পত্র প্রকাশ করে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপকতা অস্বীকার করেন। তারা দাবি করেন, "মাত্র ৯ জন শিক্ষক নিহত হয়েছেন, এবং তা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কারণে।"

পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক চাপ

পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান লাহোরে সংবাদ সম্মেলনে বলেন:

  • রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে

  • শেখ মুজিবের বিচার শিগগিরই শুরু হবে

৪. ঐতিহাসিক তাৎপর্য

৭ জুলাইয়ের ঘটনাবলি প্রমাণ করে:

মুজিবনগর সরকারের দৃঢ়তা: আলোচনার পথ বন্ধ করে সরাসরি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত।

আন্তর্জাতিক সমর্থন: ভারত, জার্মানি ও কানাডার অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে।

পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা: কূটনীতিকদের বিদ্রোহ ও অভ্যন্তরীণ চাপ।

এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের গতিপথকে ত্বরান্বিত করেছিল, যা পরবর্তীতে ডিসেম্বরের বিজয়ে ভূমিকা রাখে।

সূত্র:

ইত্তেফাক, ৮ ও ৯ জুলাই ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা (ভারত), ৮ ও ৯ জুলাই ১৯৭১

আন্তর্জাতিক মিডিয়া রিপোর্টস

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০