ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২৫ জুন ১৯৭১: গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৫, ১২:০০ পিএম
ছবি: আনন্দবাজার

১৯৭১ সালের ২৫ জুন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানানো হয়, ভারতীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে এবং মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সফল অভিযান চালায়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের আহ্বান

এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর মহাসচিব টুংকু আবদুল রহমানকে একটি জরুরি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা বন্ধে ওআইসির হস্তক্ষেপ কামনা করেন। নজরুল ইসলাম বলেন, "পাকিস্তানি বাহিনী ধর্মের নামে বাংলাদেশে নারকীয় গণহত্যা চালাচ্ছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে। ওআইসি যদি ইসলামী নীতিতে বিশ্বাসী হয়, তবে তাদের এই বর্বরতার প্রতিবাদ করা উচিত।"

উল্লেখ্য, এর আগে জেদ্দায় ওআইসির সম্মেলনে পাকিস্তানের "একতা ও সংহতি" রক্ষার পক্ষে সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের এই আহ্বান ছিল ওআইসির সেই অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার একটি কূটনৈতিক প্রয়াস।

ভারতের অবস্থান: রাজনৈতিক সমাধানের পথ

দিল্লিতে "পূর্ব বাংলায় চলমান জটিলতা ও সমাধান" শীর্ষক তিন দিনব্যাপী এক আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, "এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে তাৎক্ষণিক লাভ নেই। আমরা পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করছি।" তিনি উল্লেখ করেন, ৬০ লাখ শরণার্থীর ভারতে অবস্থান দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংসদীয় কমিটিতে সতর্ক করে বলেন, "যদি শিগগির বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক সমাধান না আসে, ভারতকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।"

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও বিক্ষোভ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এদিন পাকিস্তানকে দেওয়া দুটি অস্ত্র সরবরাহের লাইসেন্স বাতিলের ঘোষণা দেয়। তবে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, কারণ লাইসেন্স দুটি ৩১ মার্চ ও ৬ এপ্রিল মঞ্জুর করা হয়েছিল—যা বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর পরের ঘটনা।

দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের দ্বিতীয় সচিব কে. এম. শেহাবউদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেন এবং পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা বন্ধের দাবি জানান। একই দিনে ভারতীয় জনসংঘের নেতৃত্বে মার্কিন দূতাবাসের সামনে আরও একটি বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য

  • মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনারকে জানান, শরণার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ৭ কোটি ডলার সাহায্য দেওয়া হবে।

  • পূর্ব জার্মানি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

  • অস্ট্রিয়া ১ লাখ ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের মাঠে অগ্রগতি

  • টাঙ্গাইল: কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা নাগরপুর থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র ও রেডিও সরঞ্জাম লুট করে। পুলিশ বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

  • ময়মনসিংহ: ভালুকায় আফসার বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে ৯৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

  • মৌলভীবাজার: মুক্তিযোদ্ধারা বিয়ানীবাজার থানা সার্কেল অফিসে গ্রেনেড হামলা চালায় এবং সমনবাগ চা বাগানে আক্রমণ করে ১৫ জন রাজাকার ও প্রহরী নিহত হয়।

  • লক্ষ্মীপুর: মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানিদের বাগবাড়ি ক্যাম্পে হতাহতের ঘটনা ঘটে।

পাকিস্তানের প্রচারণা ও বাস্তবতা

পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ভারতে থাকা শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে ২৩টি অভ্যর্থনা শিবির তৈরি করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের রিপোর্টে দেখা যায়, এসব শিবিরে শরণার্থীদের উপস্থিতি নগণ্য।

বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ. আর. মল্লিক লক্ষ্ণৌতে এক সমাবেশে বলেন, "পাকিস্তানি বাহিনী শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যাই নয়, বাংলাদেশের সম্পদও লুট করছে। বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের আহ্বান, এই গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।"

২৫ জুন ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই গতি পায়। আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা, ভারতের সতর্ক কৌশল, এবং মুক্তিবাহিনীর সফল অপারেশন—সব মিলিয়ে এই দিনটি স্বাধীনতা অর্জনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে আছে।

সূত্র

  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (৭ম, ১০ম, ১২শ, ১৩শ খণ্ড)

  • দৈনিক ইত্তেফাক, আজাদ, আনন্দবাজার পত্রিকা (২৬ জুন ১৯৭১)

  • আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন (এপি, ইউনাইটেড প্রেস)

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০