ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

২০ মে ১৯৭১: লাল টকটকে রক্তে ভেসে গিয়েছিল ভদ্রা নদীর পানি

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২০ মে ২০২৫, ০১:২২ পিএম
চুকনগর গণহত্যা স্মৃতি স্তম্ভ। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং নানা ঘটনার ভূমিকা রয়েছে। এখানে তুলে ধরা হলো একাত্তরের এই দিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি।

স্বাধীন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২০ মে ঘোষণা করেন, প্রবাসী সরকারই বাংলাদেশের জাতীয় সরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ৯৮ শতাংশ ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করেছেন। তাই আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কাউকে নিয়ে সরকার গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই।

তিনি আরও বলেন, মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছেন, সরকার তা স্বাগত জানায়। ভাসানী ইয়াহিয়া খানকে যে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তা সরকারেরও অবস্থান।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, চলমান যুদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, এটি পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই লড়াই ইসলামসহ সকল ধর্মের মূল্যবোধ রক্ষার জন্য। আমাদের লক্ষ্য শোষণমুক্ত, সমতাভিত্তিক ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে মাতৃভূমি হিসেবে মানেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকেন—এমন সবাই আমাদের ভাই, তাদের ধর্ম যাই হোক।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি অধ্যাপক রেহমান সোবহান জানান, বাংলাদেশে অন্তত আড়াই লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রধানত নিরস্ত্র ও নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে। তারা গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করছে এবং নাপাম বোমা ব্যবহার করছে।

পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখার নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে প্রশ্ন তোলেন, বিশ্বজনমত পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে থাকলেও রাষ্ট্রগুলো কেন নিষ্ক্রিয়? তাঁরা জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে পাকিস্তানের জন্য সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানান।

ভারতে শরণার্থী সহায়তা

কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী জি এম সাদিক বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দুই লাখ টাকার চেক পাঠান। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সমর্থনের একটি ক্ষুদ্র নিদর্শন।

পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীদল দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশে গণহত্যা ও শরণার্থী সংকট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ: দ্য ট্রুথ নামে একটি সচিত্র বই পাঠিয়েছে। এতে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

সীমান্তে পাকিস্তানি আগ্রাসন

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বনগাঁ ও বালুরহাট সীমান্তে ভারতীয় এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। এতে দুই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী আহত হন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘের আবেদনে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শরণার্থীদের জন্য পাঁচ লাখ ডলার সাহায্য দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন কোনো উন্নয়ন চুক্তি করা হবে না।

মিসরে সফররত ভারতীয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করলেও তিনি ব্যর্থ হন। পরে তিনি ইতালির উদ্দেশে রওনা দেন।

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নৃশংসতা

ঢাকায় হাতবোমা হামলার অভিযোগে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। তারা শিক্ষকদের ১ জুলাইয়ের মধ্যে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ২ আগস্টের মধ্যে ক্লাস শুরু করার নির্দেশ দেয়।

খুলনার ডুমুরিয়ায় চুকনগর বাজারে পাকিস্তানি সেনারা ১২ হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করে। এরা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য সমবেত হয়েছিল।

সিলেটের বালাগঞ্জে পাকিস্তানি সেনারা গালিমপুর গ্রামে ৩০-৩২ জন হিন্দুকে হত্যা করে, সম্পদ লুট করে এবং গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। নলুয়া চা-বাগানে আরও ২০ জন নিরীহ শ্রমিক নিহত হয়।

কুষ্টিয়ার বল্লভপুর মিশনারি গির্জা লুট করার পর পাকিস্তানি সেনাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এতে বেশ কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।

সূত্র: পূর্বদেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর (২১-২২ মে ১৯৭১)

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০