

জাতিসংঘে বাংলাদেশ ইস্যু
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের বৈঠকে ১৩ মে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ভারতের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয় যে, পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি রিটা হাউজার স্পষ্ট জানিয়ে দেন, পাকিস্তান যেভাবে এই সংকটকে “ঘরোয়া বিষয়” বলে প্রচার করছে, যুক্তরাষ্ট্র তা মানতে নারাজ।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন পূর্বদিনই পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে লাখো মানুষকে সামরিক আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। পাকিস্তান এতে আপত্তি জানালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জোর দিয়ে বলেন, মানবাধিকার ইস্যুতে যে কোনো দেশই প্রশ্ন তুলতে পারে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিত মানুষের প্রতি সমবেদনা জানান এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের ২.৫ মিলিয়ন ডলার অনুদানের কথা উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানে জরুরি ত্রাণ কার্যক্রমের প্রস্তাব দিলেও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তা প্রত্যাখ্যান করেন। রিটা হাউজার পাকিস্তানকে এই প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান।
আন্তর্জাতিক সাহায্য ও শরণার্থী সংকট
ভারতের স্বাস্থ্য দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দেবীপ্রসাদ চ্যাটার্জি জানান, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত বিদেশি সাহায্য এখনো পৌঁছায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র রবার্ট ম্যাকলস্কি জানান, পাকিস্তানকে ১ লাখ ৭০ হাজার টন গম সাহায্য দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, তবে বন্দর ব্যবস্থা অনুকূল না হওয়ায় তা পাঠানো যাচ্ছে না। তিনি পাকিস্তানের সমালোচনা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ বিতরণে পাকিস্তান সরকারের অসহযোগিতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করতে পারছে না। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি-র মতো তিনিও শঙ্কা প্রকাশ করেন যে, দ্রুত ত্রাণ না পৌঁছালে সেখানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।
ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর ভূমিকা
হরিয়ানা সরকার বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য ১০ লাখ টাকা অনুদানের ঘোষণা দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের ত্রাণ কমিশনার বি. বি. মণ্ডল সতর্ক করে বলেন, শরণার্থীদের চাপে রাজ্যের আর্থিক সংকট হচ্ছে। এই গতিতে চললে আগামী ৬ মাস থেকে ১ বছরে কয়েক শ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
ব্রিটিশ সম্প্রদায়ের চাপ
লন্ডন টাইমস-এ প্রকাশিত এক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের ২০০ জন সংসদ সদস্য, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানান, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করতে। তাঁরা জরুরি মানবিক সহায়তা দেওয়ারও আহ্বান জানান।
মুক্তিযুদ্ধের মাঠপর্যায়ের সংবাদ
কর্নেল ওসমানীর বিরুদ্ধে সামরিক আদালতের নির্দেশ
পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। ২০ মে-র মধ্যে না আসলে অনুপস্থিতিতেই তাঁর বিচার শুরু হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
শান্তি কমিটি ও পাকিস্তানি দখলদারিত্ব
বৃহত্তর সিলেট জেলার কিছু অঞ্চলে পাকিস্তানপন্থী শান্তি কমিটি গঠিত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনী বিক্রমপুরের লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী দখল করে।
মৌলভীবাজারের হিলালপুরে পাকিস্তানি সেনারা লন্ডনপ্রবাসী মোহাম্মদ উস্তা ও সিরাজুল ইসলামকে “রাষ্ট্রদ্রোহী” আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। তাদের লাশ মনু নদে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
যুদ্ধের বিভিন্ন প্রান্তর
সিলেটের জৈন্তাপুর ও তামাবিলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই দিন ধরে যুদ্ধ চলছিল। তামাবিলে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দখলের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়।
তেলিয়াপাড়ার বাগসাইর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি কনভয়ে অ্যামবুশ করে তাদের যানবাহন ধ্বংস করে।
কুমিল্লার সিঙ্গারবিলে মুক্তিবাহিনীর হামলায় তিন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।
বরিশালের পূর্ব নবগ্রামে মাত্র দুজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় গ্রামবাসীরা পাকিস্তানি সেনাদের একটি দলকে আক্রমণ করে চারজনকে হত্যা করে। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা অমূল্য মল্লিক শহীদ হন।
রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের পর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ হয়। শেষে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর ২, ৩, ৭ ও ৯)
পূর্বদেশ (১৪ মে ১৯৭১)
আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা, ১৪ ও ১৫ মে ১৯৭১)
মন্তব্য করুন