

বাংলাদেশ সরকার ১২ মে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টসহ বিশ্বনেতাদের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও তাঁর জীবন রক্ষার জন্য আবেদন জানায়। সরকারের বিশেষ দূত আবদুস সামাদ আজাদ এ আবেদন প্রচার করেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এছাড়া তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে অনুরোধ জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিনিধিকে জাতিসংঘে বিষয়টি উপস্থাপনের অনুমতি দেওয়ার জন্য।
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে বলেন, পূর্ব বাংলার বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
ব্রিটেনের কমন্স সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোম বিবৃতি দেন। এরপর সদস্য হিকি বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক তাণ্ডবের ইতিহাসে তুলনা বিরল। তিনি শুধু ত্রাণসাহায্য নয়, বাংলাদেশ বিষয়ে জাতিসংঘের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপেরও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
এদিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে, কেন তারা পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত বিমান ও ট্যাংক ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে ভয়াবহ মানবিক সংকট
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক বিশেষ প্রতিবেদক ঢাকা সফর শেষে জানান, শকুনের দল এত বেশি মৃতদেহ খেয়েছে যে তাদের আর উড়ার শক্তি নেই। মার্চ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ বাঙালির মৃতদেহ শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়েছে।
ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে ও বিপক্ষে কার্যক্রম
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পেগভ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ও শরণার্থী সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। কূটনৈতিক মহলের ধারণা, বাংলাদেশ সংক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েও তারা কথা বলেছেন।
এদিনই সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ফিজ রিলসও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক মুখপাত্র জানান, শরণার্থী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ইন্দিরা গান্ধী ১৬ মে পশ্চিমবঙ্গ সফর করবেন।
এদিকে, বাংলাদেশ সাহায্য সমিতির একটি প্রতিনিধিদল কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলীর হাতে আর্থিক সহায়তা তুলে দেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত এ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। এর আগে তারা সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরাসরি প্রয়োজনীয় রসদ পৌঁছে দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের অবস্থান ও বাংলাদেশে সামরিক তৎপরতা
পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘকে জানায়, তারা উ থান্টের প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে সাহায্য কার্যক্রম গ্রহণ করবে, তবে তা নিজেদের ব্যবস্থাপনায় বিতরণ করবে।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) প্রধান নুরুল আমিন পশ্চিম পাকিস্তানে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী শাসন কোনো কাজে আসবে না।
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ জানায়, সুনামগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে এসেছে। এদিন নারায়ণগঞ্জে ১২৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া পাকিস্তানি সেনারা সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর সেতু দখলের জন্য ট্যাংক ও কামান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর এক ও দুই
পূর্বদেশ, ১৩ মে ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৩ ও ১৫ মে ১৯৭১
মন্তব্য করুন