

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিল দেশি-বিদেশি অসংখ্য ব্যক্তি ও সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। নিচে ১৯৭১ সালের ৪ মে তারিখের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো।
যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বাংলাদেশ ইস্যু
যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে এদিন পাকিস্তান সংক্রান্ত সরকারি নীতির বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ সভায় উপস্থিত থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে কথা বলেন এবং দেশটির অখণ্ডতা বজায় রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
হিথ জানান, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন এবং এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তিনি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে পাকিস্তানে জরুরি সাহায্য পাঠানোর ঘোষণা দেন। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই সাহায্যের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। এছাড়া, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের কূটনৈতিক যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
লেবার পার্টির সদস্য মাইকেল বার্নস পাকিস্তান সরকারের সামরিক অত্যাচারের প্রতিবাদে দেশটিকে সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করার দাবি জানান। তবে প্রধানমন্ত্রী হিথ এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানে পর্যবেক্ষক প্রেরণের সম্ভাবনা উল্লেখ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা স্থগিত রাখার প্রস্তাব অনুমোদন করে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাহায্য দল প্রেরণের জন্য নিক্সন সরকারের প্রতি জোরালো দাবি জানান। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সমালোচনা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুর্দশা লাঘবে সংস্থাটি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়
জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে বাংলাদেশের সংকট ও শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন।
এদিকে, রেডক্রসের জেনেভা কার্যালয় থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের সহায়তায় বিশ্বের ১৩টি দেশের রেডক্রস সোসাইটি এগিয়ে এসেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য।
মালয়েশিয়ার ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টির সম্পাদক ফ্যান ইউ তেন কুয়ালালামপুরে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে চলমান নৃশংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, তাঁর সংগঠন বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারাভিযান চালাবে।
ভারতের অবস্থান
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম সতর্ক করে দিয়ে বলেন, পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করে সীমান্তে সংঘাত সৃষ্টি করে, তবে ভারত কঠোর জবাব দেবে।
এছাড়া, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাজনৈতিক উপদেষ্টা লি টি স্টলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে হস্তক্ষেপের দাবি জানান। স্টল এই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণের আশ্বাস দেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান এদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল পরিদর্শন করেন।
এদিকে, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা শাহ আজিজুর রহমান ভারতের হস্তক্ষেপের নিন্দা করে বলেন, এটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন।
চাঁদপুরে শান্তি কমিটির আয়োজনে একটি মিছিল বের করা হয়। অন্যদিকে, সিলেটের পুষাইনগরে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালিয়ে ১৫ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
সূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র (ত্রয়োদশ খণ্ড)
দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ, ৫ মে ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ৫ মে ১৯৭১
মন্তব্য করুন