

আন্তর্জাতিক সমর্থন ও আহ্বান বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতারের গোপন কেন্দ্র থেকে এদিন এক বেতার ভাষণে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। এছাড়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে অর্থ ও অস্ত্রের জন্য তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আবেদন করেন।
এদিন ভারতের বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে বিশ্বজনমত গঠনের লক্ষ্যে তিনি কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ জানান, তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল শীঘ্রই জাতিসংঘে যাবে। এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য লন্ডন থেকে একটি শান্তি পদযাত্রারও পরিকল্পনা করা হয়েছে।
দিল্লিতে গান্ধী ফাউন্ডেশনের সম্পাদক রাধাকৃষ্ণ জানান, ভারতের গান্ধীবাদী সংগঠনগুলো বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিদল প্রেরণের পরিকল্পনা করছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, একটি আন্তর্জাতিক শান্তি অভিযানের প্রস্তুতি চলছে, যেখানে যুদ্ধবিরোধী সংগঠনগুলো অংশ নেবে।
ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের প্রতিক্রিয়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান ভারতের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে দেশে ফিরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার নিন্দা করেন। তিনি বলেন, "বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।" তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং পাকিস্তানকে অর্থ援助 বন্ধ করার সুপারিশ করবেন বলেও জানান।
বিশ্বশান্তি পরিষদের এক সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ নির্বাচিত নেতাদের জীবন রক্ষার আহ্বান জানানো হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন অবস্থান সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি পাঠান।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ভারতের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণসামগ্রী ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টও পূর্ব পাকিস্তানে সাহায্য পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করেন।
ভারতীয় মুসলিম নেতাদের সমর্থন ভারতের মুসলিম নেতারা পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার নিন্দা করেন। দিল্লির সংসদ সদস্য জুলফিকার আলী খান আরব দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুসলিম নেতারাও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উদ্যোগ কলকাতায় বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির পক্ষে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায় ও অন্যান্য বিশিষ্টজন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগের আহ্বান জানান। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে নারীদের জন্য একটি পৃথক বিভাগ খোলা হয়।
সীমান্তে উত্তেজনা ভারত পাকিস্তানের কাছে তিনটি কূটনৈতিক নোট পাঠিয়ে সীমান্তে ভারতীয় নাগরিক হত্যার প্রতিবাদ জানায়। ২৬ থেকে ২৮ এপ্রিলের মধ্যে চারটি ঘটনায় ৩৩ জন ভারতীয় নিহত হয়েছেন বলে জানানো হয়। এদিন পাকিস্তানি সেনারা যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতের মালিদা গ্রামে অনুপ্রবেশ করে গুলিবর্ষণ করলেও বিএসএফ-এর পাল্টা আক্রমণে তারা পিছু হটে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পরিস্থিতি পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার মিরপুরে বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। স্থানীয় অবাঙালিদের সহযোগিতায় বহু বাঙালিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়, যাদের অধিকাংশই আর ফিরে আসেননি।
সিলেটের মাধবপুরে পাকিস্তানি সেনাদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের মনতলায় সরে যান। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং দুই মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড); বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস; দৈনিক পাকিস্তান, ২৯ এপ্রিল ১৯৭১; আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল ১৯৭১।
মন্তব্য করুন