ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২
মুক্ত মনমুক্ত চিন্তামুক্তি গাথা

১৭ এপ্রিল ১৯৭১: মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ

প্রিয়ভূমি প্রতিবেদক
১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১৮ পিএম
১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৯ এএম
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম | ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষের একক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা, নানা ঘটনা ও ত্যাগের ইতিহাস। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল, ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিনে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

সেদিন সকাল ১১টায় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (বর্তমানে মুজিবনগর) নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই অঞ্চল ছিল মুক্তাঞ্চল। শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ এবং দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এই ঘোষণাপত্র পাঠের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক। তবে তিনি পাকিস্তানে বন্দি থাকায় উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

শপথ গ্রহণ শেষে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের নাম ঘোষণা করেন। মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী এবং চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম আবদুর রব।

অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর দুটি প্লাটুন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে সামরিক অভিবাদন জানায়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের হুইপ আবদুল মান্নান। সূচনা হয় পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে এবং সমাপ্তি ঘটে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবেশনের মাধ্যমে।

অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে নতুন জাতির জন্ম হলো। বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। এই নতুন রাষ্ট্রকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই রোধ করতে পারবে না।”

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বক্তব্যে বলেন, “বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছে, পাকিস্তান সরকার তা আড়াল করতে মরিয়া। আমাদের এই যুদ্ধ পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। এটি আত্মনিয়ন্ত্রণের, জীবন-মৃত্যুর লড়াই। আজ অখণ্ড পাকিস্তান মৃত। লাখো শহীদের রক্তে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “এই জাতিকে কোনো শক্তি ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক—সব রাষ্ট্রকে এ জাতিকে স্বীকৃতি দিতেই হবে। জাতিসংঘেও স্থান দিতে হবে।”

তাজউদ্দীন আহমদ পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানান, যেন তারা ইয়াহিয়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রের সহানুভূতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশের দিক থেকেও সমর্থন প্রত্যাশা করেন তিনি।

তিনি বলেন, “বিশ্বের আর কোনো জাতি বাঙালির মতো স্বীকৃতি পাওয়ার এত বড় দাবিদার নয়। কারণ, আর কোনো জাতি এমন কঠিন সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেনি।”

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড), মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি: আমীর-উল ইসলাম (কাগজ প্রকাশনা)।

অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মহান বিজয় দিবস: গৌরবের দিনে প্রশ্নের ছায়া

১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ের এক ঘটনাবহুল দিন

পরের নোবেলটি কার? ইউনুস না শফিক?

এই পতাকা কাদের? / কে চেয়েছে এই পতাকা???

এখন আমাদের ত্রাণকর্তা কে? / ইউনুস, ডোভাল না রজার???

৪ অক্টোবর ১৯৭১: বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায়

১ অক্টোবর ১৯৭১: রায়পুরের রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেরিলাদের আক্রমণ

হাসনাবাদ গণহত্যা (নবাবগঞ্জ, ঢাকা)

কাটেঙ্গা গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: ‘পূর্ব বাংলার সমস্যার সমাধান শেখ মুজিবের সঙ্গেই করতে হবে’

১০

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: “বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাত হয়ে গেছে”

১১

২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: জাতিসংঘে বাংলাদেশ নিয়ে নাটকীয়তা

১২

সাদকপুর গণহত্যা (বুড়িচং, কুমিল্লা)

১৩

ফুলদহেরপাড়া গণহত্যা (সরিষাবাড়ী, জামালপুর)

১৪

আন্দুলিয়া গণহত্যা (ডুমুরিয়া, খুলনা)

১৫

২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিজয়ই আমাদের একমাত্র ও চূড়ান্ত গন্তব্য

১৬

জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতারণা: জনগণের অট্টহাসি ও অবিশ্বাসের প্রতিফলন

১৭

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: চালনা বন্দরে মার্কিন জাহাজ মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস

১৮

বীর উত্তম আবদুস সালেক চৌধুরী: আকাশছোঁয়া হয়ে উঠেছিল যাঁর সাহস

১৯

রামনগর গণহত্যা (রায়পুরা, নরসিংদী)

২০