জসীম উদ্দীন তার সাহিত্য নির্মাণে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তার লেখায় দেশ ও দেশের মানুষের কথা এসেছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধনির্ভর লেখাগুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এগুলো পাঠ করলে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা নতুন প্রজন্ম নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ পাবে।...
জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) বাংলা ও বাঙালির কথা আপন ভাষায় কাব্য রচনা করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। বাংলা কবিতায় দেশাত্মবোধ দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন তিনি। তাকে বলা হয়ে থাকে পল্লীকবি। কিন্তু তিনি খাঁটি বাঙালি কবি; যিনি দেশ ও মাটির সঙ্গে মর্মে মর্মে মিশে রয়েছেন। তার প্রত্যেকটি চরিত্রের দেহে মাটি, ঘাস আর নদীর ঘ্রাণ লেগে আছে। গ্রামীণ মানুষকে হঠাৎ করে আধুনিক বানানোর কমপ্লেক্স তার ভেতরে কাজ করেনি। তার কবিতায় কোনো তাত্ত্বিক গভীরতা নেই, যা আছে তা এ দেশের বাঙালি পাঠককে আকৃষ্ট না করে পারেনি। সাধারণ মানুষের মাধুর্যময় চিত্রকল্প উপস্থাপন করতে গিয়ে তার কবিতা হয়ে উঠেছে গেঁয়ো যোগীর মতো। তাতে ক্ষতি নেই বরং তার ফলে জসীম উদ্দীনের কবিতার স্বাতন্ত্র্য সহজেই চোখে পড়ে; ‘এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’ রবীন্দ্রনাথের হাতেও ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের গ্রাম, গ্রামীণ চিত্রকল্প; ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ জসীম উদ্দীন রবীন্দ্রপরিমণ্ডলে আবর্তিত হয়েও একজন আলাদা কবি। তার আলাদা ঢঙের জন্যই রবীন্দ্রনাথ জসীম উদ্দীনের কবিশক্তিকে স্বীকার করেছেন, প্রশংশা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে লোককবি মাটি ও মানুষের কথাকে যারা ফোক অভিধা দিয়ে থাকেন, অর্থাৎ তথাকথিত নাগরিক সমাজের এলিট বর্গ। দেশ ও দেশের মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্য যারা চর্চা করেন, তাদের একটি বিশেষ বর্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন তাকে বাংলার পল্লীগীতি, লোকসাহিত্য সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি সেগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসেন। এভাবে তিনি নির্মাণ আর সৃষ্টি করেছিলেন দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য। কবি হিসেবে দেশের মানুষের প্রতি দায় ও দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন; ‘‘আমি হিন্দু, আমার কাছে বেদ পবিত্র, ভগবত পবিত্র। কিন্তু ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পুস্তকখানি তাহার চাইতেও পবিত্র। কারণ ইহাতে আমার বাংলাদেশের মাটির মানুষগুলির কাহিনী আছে।’’ তার ‘রাখালী’, নক্সী কাঁথার মাঠ’, বালুচর, ধানখেত, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রঙ্গিলা নায়ের মাঝি’ প্রভৃতি রচনা করেন। যেসব মানুষকে তিনি জানতেন, তারা সবাই ছিলেন মাটির সঙ্গে বাঁধা। সমকালে কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যবোদ্ধাদের মনোযোগ পেয়েছিলেন। যাকে বাদ দিলে, যাকে টান দিলে শেকড়শুদ্ধ উঠে আসে তেমনি আমাদের ঐতিহ্য আর আধুনিকতা। সেই কারণে আমরা উত্তর-আধুনিকদের ধারণাকেও দূরে সরিয়ে রাখি।
যেখানে জসীম উদ্দীনের কবিসত্তাই আমাদের কাছে পুরানো- সেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধনির্ভর তার সৃষ্টিকর্ম তো আড়ালে থেকেই যাবে, এটি স্বাভাবিক। ‘একুশের কবিতা’ নামক তার যে কবিতা তা এখনো একুশের মহৎ কবিতাগুলোর মতোই আধুনিক ও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নামে-বেনামে তিনি অনেক লেখা লিখেছিলেন। তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রাশিয়া, আমেরিকা, ভারতসহ বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হলে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল। একজন দেশপ্রেমিক শিল্পীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। মহৎ যেকোনো শিল্পী দেশের দুর্দিনে নীরব থাকতে পারেননি। কবি-সাহিত্যিকদের তাদের হাতের কলমকেই যুদ্ধাস্ত্র করে কাঁপিয়ে দেন শত্রুশিবির। সৈয়দ হক বিদেশে, আল মাহমুদ, জহির রায়হান পশ্চিমবঙ্গে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যান, তেমনি শামসুর রাহমান কিংবা জসীম উদ্দীন দেশের মধ্যে থেকে জীবন বাজি রেখে দেশের মাটিতে যুদ্ধ করেন। জাতির জীবনে এ এক মহত্তম ঘটনা। বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এসব কবিতা মুক্তিযুদ্ধনির্ভর উৎকৃষ্ট দলিল। বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যহারা রূপসী বাংলায় আজ খানসেনাদের নির্মম অত্যাচারের অনন্য করুণ ছবি আঁকেন কবি।
সে বাঙলা আজি বক্ষে ধরিয়া দগ্ধ গ্রামের মালা
রহিয়া রহিয়া শিহরিয়া উঠে উগরি আগুন জ্বালা
দস্যু সেনারা মরণ-অস্ত্রে বধি ছেলেদের তার
সোনার বাঙলা বিস্তৃত এক শ্মশান কারাগার। [কবির নিবেদন]
পাকিস্তানিদের নির্মম বর্বরতা তিনি ‘নিষ্ঠুর এজিদের কারাগার’ হিসেবে একে ভাঙতে চেয়েছেন। আবার ‘ইসলামী ভাই’ কবিতায় তিনি পূর্ব-পশ্চিম একই ধর্ম বন্ধনে আবদ্ধ একথা বলতে তিনি ভোলেননি। কোরআন এক, রসুল এক এবং এদিক দিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাই জ্ঞান করেছেন- ‘আপেল আনার সঙ্গে এনেছে’ মনে করে সরল বিশ্বাসে। সহসাই ভুল ভাঙে চিরকালীন সহজ-সরল বাঙালিদের। এ দেশীয়দের শয়তানরা ধর্মের অপব্যাখ্যা, কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যায় স্বার্থ হাসিলের কাজ করেছে। যে যেমন পারে ব্যাখ্যা দাঁড় করায়, জোট বাঁধে ধর্মের দাওয়াই দিতে সুবিধা করার জন্য।
রহিয়া রহিয়া রসুলের বাণী রেডিও টেলিও হতে
বিকৃত হয়ে ছড়ায়ে চলেছে বিষ বাষ্পের স্রোতে,
নর হন্তারা আজিকে হয়েছে শ্রেষ্ঠ ইমানদার
লুণ্ঠনকারী জালিম নিয়েছে দেশের শাসন ভার।
এত সরাসরি এত মাটিগন্ধা ভাষার আর কোন কবি যুদ্ধকালীন বাস্তবতা বর্ণনা করেছেন। তার মুক্তিযুদ্ধের এক কবিতায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আর স্বাধীনচেতা বাঙালিরা নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। জসীম উদ্দীন ‘কি কহিব আর’ কবিতায় লিখেছেন;
‘এসব কাহিনি কহিবার মানা লিখিবার মানা হায়
কবির কলম বড় অবাধ্য না লিখে বাঁচা যে দায়।
মায়াঘেরা সে বাংলাদেশ যেন কংকাল; একাত্তরের মে মাসে ‘দগ্ধ গ্রাম’ শিরোনাম চিরকাল গ্রামকে ভালোবেসে লিখেছেন। মানুষের রক্তে-খুনে ছায়া-সুশীতল গ্রামগুলো আপন সৌন্দর্য হারিয়ে যেন মৃতপ্রায় মায়া। নির্মম সত্য মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছিল। অসাম্প্রদায়িকতা বাঙালির কথা তিনি লিখেছেন; ‘গীতারা কোথায় যাবে?’ ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ‘জাগিয়া তুলিবা আশ’ কবিতাগুলোতে কবির মানবতাবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা কখনো পুরাতন হয় না, তেমনি ধুলোমাখা হতে পারে না রক্তের আঁচড়ে লেখা সাহিত্যকর্ম।
মন্তব্য করুন