রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন, ‘আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারী’, বলেছিলেন তিনি। জমিদারির চেয়ে অবশ্য অনেক অনেক বড় ছিল তার আসমানদারি। তাঁর চিঠিতে আছে, ‘আমার স্বীকার করতে লজ্জা করে এবং ভেবে দেখতে দুঃখ হয়- সাধারণ মানুষের সংসর্গ আমাকে বড় বেশি উদ্ভ্রান্ত করে দেয়- আমার চারিদিকেই এমন একটা গণ্ডি আছে আমি কিছুতেই ভাঙতে পারিনে- অথচ মানুষের সংসর্গ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাও আমার পক্ষে স্বাভাবিক নয়- থেকে থেকে মানুষের মাঝখানে গিয়ে গড়তে ইচ্ছা করে- মানুষের সঙ্গে যে জীবনোত্তাপ তাও যেন প্রাণ ধারণের পক্ষে আবশ্যক।’ (‘ছিন্নপত্র’, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯১৪)।
রাষ্ট্রের তুলনায় সমাজ সম্পর্কে অনেক বেশি বলেছেন তিনি। তপোবনের কথা তার রচনার নানা স্থানে পাওয়া যায়। এই তপোবন গান্ধীর রামরাজ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে হয়তো, কিন্তু তবু তফাৎ আছে। রবীন্দ্রনাথের তপোবন ভবিষ্যতের স্বপ্ন, গান্ধীর রামরাজ্য অতীতের স্মৃতি। গান্ধী মোটেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না; ধর্মের চেয়ে মানুষ বড় এটা তিনি সর্বদাই বলেছেন, কিন্তু গান্ধী যে ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন সেটাও সত্য। কাজটা তিনি শুরু করেননি, মিশ্রণের ব্যাধি আগেই ছিল, কিন্তু এই ব্যাধিকে তিনি নিরুৎসাহিত না-করে বরঞ্চ উৎসাহিত করেছেন।
বললে অন্যায় হবে না যে, গান্ধী যে অর্থে ইহজাগতিক হতে অস্বীকার করেছেন, রবীন্দ্রনাথ প্রায় সে অর্থেই ইহজাগতিক ছিলেন। গান্ধী ইতিহাসে উৎসাহী ছিলেন না, কেননা সত্যের কোনো ইতিহাস নেই বলে তিনি মনে করতেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসে বিশ্বাসী ছিলেন, সে ইতিহাস রাজা-বাদশার মারামারি কাটাকাটির বিবরণ নয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ইতিহাস বটে। এই ইতিহাস জনগণ রচনা করে, কঠিন শ্রমে। রবীন্দ্রনাথের লেখায় দেখব তার গভীর আস্থা ছিল ইহজাগতিকতার দুটি ভিত্তিতে- বিজ্ঞানে ও যুক্তিবাদিতায়। গান্ধীর সঙ্গে এ ব্যাপারে তার বিরোধের অত্যন্ত নাটকীয় প্রকাশ ঘটেছিল, বিহারে যখন ভয়ংকর এক ভূমিকম্প ঘটে তখন। ১৯৩৪-এর সেই ঘটনার সময় গান্ধী বলেছিলেন, ‘এ হচ্ছে অস্পৃশ্যতার পাপের জন্য বিধাতা প্রেরিত শাস্তি।’ রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করেন। রাজনীতিক গান্ধীর সমালোচনা করে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, ‘গান্ধী যে শুধু ঈশ্বরকে টেনে আনছেন তা নয়, তিনি এমন এক ঈশ্বরের ধারণা প্রচার করেছেন যিনি পাপীকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিষ্পাপকেও সাজা দিয়ে ফেলেন। তার চেয়েও বড় কথা, গান্ধী সেই অন্ধত্বকেই শক্তিশালী করেছেন যা মানুষের দুর্ভোগের কারণ খোঁজে ঐশ্বরিক জগতে।’ গান্ধী এর উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি। তবে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন।
সমাজে বিচ্ছিন্নতার দৌরাত্ম্য যে বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ উদ্বিগ্ন ছিলেন, জানতেন যে এর প্রধান কারণ হচ্ছে বৈষম্য, পুঁজিবাদ যে বৈষম্যকে পুষ্ট করেছে, কিন্তু তাই বলে এই মত তিনি প্রচার করেননি যে, যন্ত্রকে পরিত্যাগ করে চলে যেতে হবে কুটিরশিল্প ও ব্যক্তিগত উৎপাদনের যুগে। ‘রক্ত করবী’তে পুঁজিবাদের প্রাণবিনাশী বস্তুতান্ত্রিকতার ভয়াবহতাকে তিনি আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন। কমিউনিস্টদের তিনি বলপ্রয়োগকারী হিসেবেই জানেন, কিন্তু ‘অমৃত’ নামের কবিতায় অমিয়া যে জেলগেটে রায়বাহাদুরনন্দন কমিউনিস্ট মহীভূষণকে বরণ করে নিচ্ছে সেটা এই ভরসাতেই যে, মহীভূষণ তাকে মুক্তি দেবে অন্য এক কারাগার থেকে, সে কারাগার উপকরণের, সে কারাগার বস্তুতান্ত্রিকতার। পরাধীন ভারতে ভারতবাসী যে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল তার প্রধান কারণ এই নয় যে, দেশ অন্যরা দখল করে নিয়েছিল, প্রধান কারণ এটা যে, সেবা ও ত্যাগের দ্বারা দেশকে ভারতবাসী নিজেদের আত্মীয় করে নিতে পারেনি। কারণ অবশ্য আরও একটি ছিল। সেটি ধনবৈষম্য। ‘মোটকথা হচ্ছে, দেশের যে অতিক্ষুদ্র অংশে বিদ্যাবুদ্ধি, ধনমান, সেই শতকরা পাঁচ পরিমাণ লোকের সঙ্গে পঁচানব্বই পরিমাণ লোকের ব্যবধান মহাসমুদ্রের ব্যবধানের চেয়ে বেশি।’ ‘আমরা এক দেশে আছি, অথচ আমাদের এক দেশ নয়।’ (‘পল্লী সমাজ’) তিনি জেনেছেন, ‘রাশীকৃত বিচ্ছিন্নতাকে কেবলমাত্র স্তূপাকার করিতে থাকিলেই তারা এক হয় না।’ (‘স্বদেশী সমাজ’) এবং এ উপলব্ধিও অত্যন্ত প্রখর ছিল তার কাছে যে, ‘বিচ্ছিন্নতা যেখানে প্রবল সেখানে বিপ্লব না এলে তার সমন্বয় হয় না, কিন্তু রাষ্ট্রতন্ত্রে, কী সমাজতন্ত্রে, কী ধর্মতন্ত্রে’। (‘সামঞ্জস্য’, ‘শান্তিনিকেতন’)।
ধনবৈষম্য তাই দূর করা আবশ্যক, কিন্তু কাজটা ‘জবরদস্তি’ দ্বারা সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলুপ্ত করাও অসম্ভব কাজ। এই দুই সত্যকে মেনে নিয়ে তিনি একটি ‘মাঝামাঝি সমাধান’ সন্ধানের কথা বলছেন। বলা বাহুল্য, ওই মাঝামাঝি সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি, এবং ইতোমধ্যে ধনবৈষম্য এবং তার ফলে বিচ্ছিন্নতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমাজের দুর্বলতাগুলো ভেতর থেকে সংশোধন করতে হবে; সে সমাধান সামাজিক বটে, রাজনৈতিক নয়, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। সে উদ্যোগ তিনি ব্যক্তিগতভাবেও নিয়েছেন; কৃষিব্যাংক, সমবায়, বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয় এসব পরিকল্পনা তিনি কার্যকর করেছেন, তার নিজের মতো করে; কিন্তু এসব যে বৃহৎ অগ্নিকাণ্ডের মুখোমুখি হয়ে কয়েক বালতি জল নিক্ষেপ মাত্র, এ-ও তিনি জানতেন। তবু শুরু করতে হয়, এগিয়ে আসতে হয়। তিনি এগিয়ে গেছেন। জরুরি ছিল নেতৃত্ব গড়ে তোলা। সমাজকে পরিচালনা করার জন্য নেতা দরকার। ‘আমাদের প্রথম কাজ হইবে’, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যেমন করিয়া হউক একটি লোক স্থির করা এবং তাঁহার নিকট বশ্যতা স্বীকার করিয়া ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে তাঁহার চারিদিকে একটি ব্যবস্থাতন্ত্র গড়িয়া তোরা।’ (‘স্বদেশী সমাজ’) পরে সংশোধন করে বলেছেন, ‘একজন নয়, দু’জন সমাজপতির আবশ্যক হবে। এই দু’জন আসবেন দুই সম্প্রদায় থেকে।’ এখানে সমাধানের চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে স্বীকৃতি। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন যে, সমাজে একটি নয়, দু’টি সম্প্রদায় রয়েছে। মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বটে, কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের বিবেচনার মধ্যে না-আনলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, সমস্যা প্রবল থেকে প্রবলতর হবে, এবং তা হয়েছেও, হয়ে বঙ্গভূমিকে দু-টুকরো করে ফেলেছে। মধ্যখানে নদী নেই, নদী যাচ্ছে শুকিয়ে, যাতে প্রবলতর হচ্ছে দূরত্ব।
রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে এই চিন্তাধারার উত্তরাধিকার তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন। এর সবটা নির্বিচারে গ্রহণ করতে হবে, এ শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেননি। দেবেন না। গ্রহণের স্বার্থেই বর্জনও প্রয়োজন হবে, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবনই ওই কাজটি করেছেন। কিন্তু বর্জনের মধ্যেও শেখার থাকবে অনেক কিছু।
চিন্তাও রুচিরই অংশ বটে। সর্বজনীন তো নয়ই, ব্যাপকভাবে গৃহীত কোনো রুচিও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। মানুষ ভাগ হয়ে গেছে শ্রেণিতে ও সম্প্রদায়ে। দেশও ভাগ হয়ে গেছে। দেশের এই ভাগাভাগিটা রবীন্দ্রনাথকে দেখতে হয়নি, নজরুলও করুণভাবে বেঁচে গেছেন সম্বিতহারা হওয়ার দরুন, জীবনানন্দ দাশ এর ফলে উদ্বাস্তু হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কলকাতার বৈরী পরিবেশে। ক্ষতি হয়েছে অর্থনীতির, নদীর, সংস্কৃতির। এখন আবার নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে বিশ্বায়নের, যার মর্মার্থ হচ্ছে একচেটিয়া লগ্নিপুঁজির দুর্বৃত্তায়ন। সেই যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আমরা একবার চলে গিয়েছিলাম, তার অভিশাপ থেকে এখনো মুক্ত হইনি, তার ওপর আবার আরও ভয়ংকর কিন্তু ছদ্মবেশী অভিশাপ নেমে আসতে চাইছে।
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, নিজের স্বাভাবিকতা ও সৃষ্টিশীলতাকে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় যে প্রতিরোধ তার জন্য রবীন্দ্রনাথ অনিবার্য বৈকি। এই প্রতিরোধ ইতিবাচকও বটে- অর্থাৎ, এর জন্য রুচিকে গড়ে তোলা চাই, যেখানে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসহচর। আত্মসমর্পণ যে ধ্বংসের নামান্তর, রবীন্দ্রনাথের সাধনার মধ্যে এই বাণী নিরন্তর উচ্চারিত। তিনি পথ দেখান এবং আশা দেন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন